‘আমার আশা ছেড়ে দেও তোমরা, আমাকে পাইবা না
ই-বার্তা ।। স্বামীর সোহাগে তুষ্ট ছিলেন না তৃপ্তি। অভিমানী তৃপ্তি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ৫ দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন তৃপ্তি। স্বামী, পিতা-মাতা হন্য হয়ে খুঁজেছেন তাকে কিন্তু পাননি। অবশেষে গত বুধবার তৃপ্তির গলিত লাশ মিলল সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা নদীতে। তবে- এরই মধ্যে তৃপ্তির মৃত্যু নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। পুলিশ জোর দিয়ে বলছে- তৃপ্তি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু সুরমা নদীতে তৃপ্তি কীভাবে আত্মহত্যা করলো সেই প্রশ্নের কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
লাশ উদ্ধারের পর পিতার মামলায় তৃপ্তির স্বামী রিংকুকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু রিংকুর মুখ থেকে পাওয়া তথ্যের জোরালো যুক্তির হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। তৃপ্তির পুরো নাম বৈশাখী ধর তৃপ্তি। বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার দাশপাড়া গ্রামে। তৃপ্তির পিতা আশুতোষ ধর। আর তার স্বামী রিংকু ধর সিলেটের পল্লী বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স পাস করা তৃপ্তি ছিলেন সিলেট রেলওয়ের মেইল বিভাগের কর্মকর্তা। এক বছরও হয়নি তৃপ্তি ও রিংকুর বিয়ের। দুই চাকরি জীবনও বেশি দিনের নয়। দুই বছর আগে তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় ৮ মাস আগে সুখের সংসার পেতেছিলেন। বিয়ের পর রিংকু ও তৃপ্তি বাস করতেন দক্ষিণ সুরমার মাহবুব কমপ্লেক্সের ভাড়া বাসায়। দুই জনই চাকরিজীবী। সকাল থেকে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
বিকেলে তারা ঘরে ফিরতেন। বিয়ের পর ভালই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু প্রায় দুই মাস আগে রিংকু ও তৃপ্তির মধ্যে মনোমানিল্য দেখা দেয়। চাকরিতে ব্যস্ত থাকায় তৃপ্তি স্বামী রিংকুকে ততটা সময় দিতে পারতেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। সাংসারিক জীবনে কিছুটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসেরও সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে তাদের সংসারে প্রায় সময়ই ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো। এমনকি মাঝে মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ থাকে। রিংকু ও তৃপ্তির পরিবারের সদস্যরা এসে তাদের বিবাদ প্রায় সময় মিটিয়ে দিয়ে যান। শনিবার সকালে প্রতিদিনের মতো দক্ষিণ সুরমার মাহবুব কমপ্লেক্সের বাসা থেকে বের হয়ে যান বৈশাখী ধর তৃপ্তি। বাসা থেকে বের হওয়ার দিন দুপুর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এরপর স্বামী ও পিতার পরিবারের সদস্যরা হন্য হয়ে তৃপ্তিকে খুঁজতে থাকেন। এ ঘটনায় রোববার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় তৃপ্তির স্বামী রিংকু ধর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় স্ত্রী নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করেন। পাশাপাশি তারা রিংকুকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু পরিচিত জন কিংবা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি- কোথাও যায়নি তৃপ্তি। গত বুধবার দুপুরে খবর আসে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা নদীতে এক মহিলার লাশ ভাসছে। খবর পেয়ে তৃপ্তির স্বামী ও পিতার বাড়ির সদস্যরা গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন। তৃপ্তির শরীর গলে গেছে। মুখ কিছুটা বিকৃত। পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করার পর তৃপ্তির মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে- তৃপ্তির বাবা আশুতোষ ধর বাদী হয়ে তার স্বামী রিংকুর বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা করেছেন। মামলায় রিংকুর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলার প্রেক্ষিতে গত বুধবার বিকালে তৃপ্তির স্বামী রিংকু ধরকে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বৈশাখী ধর তৃপ্তির মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে পুলিশ রাতভর থানায় রেখে রিংকুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। গতকাল সকালে পুলিশ তৃপ্তির পিতার দায়ের করা মামলায় রিংকুকে আদালতে হাজির করে।
আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- বৈশাখী ধর তৃপ্তি নিজ থেকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ- তৃপ্তি নিখোঁজের খবর জানার পর পুলিশ মাহবুব কমপ্লেক্সে যায়। সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে নিখোঁজের দিন শনিবার তৃপ্তি একাই বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল না। এ ছাড়া নিখোঁজের আগের দিন তৃপ্তি তারা মা-বাবাকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছিল, ‘আমার আশা ছেড়ে দেও তোমরা। আমাকে পাইবা না। আমি আত্মহত্যা করবো।’
নিখোঁজের আগের দিন এসব কথা বলে যাওয়ায় পরিবারও ধারণা করছে সে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বলেন- এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা স্বামীর কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ওদিকে- পুলিশ সূত্র জানিয়েছে- রাতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রিংকু ধর জানিয়েছে, তৃপ্তির সঙ্গে তার মনোমানিল্য চলছিল। কয়েক দিন ধরে নানা টানাপড়েনের কারণে অশান্তি বিরাজ করছে। তৃপ্তি অফিসে বেশি সময় থাকতো। আমি কোথাও তাকে বেড়ানোর জন্য নিয়ে যেতে চাইলেও সে অফিসের দোহাই দিয়ে যেত না। এসব বিষয় নিয়েই মূলত দ্বন্দ্ব ছিল। তৃপ্তি সুরমা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। সুরমা নদীর পাশেই ভাড়া বাসায় বসবাস করে তৃপ্তি। পেছনেই কাজিরবাজার সেতু।
তবে সকালে বের হওয়া তৃপ্তি কখন আত্মহত্যা করেছে তার কোনো তথ্য মিলেনি। আর দিনের বেলা নদীতে ঝাঁপ দিলেও লোকজনের চোখে পড়তো। তার গলায়ও কোনো কিছু বাঁধা ছিল না। আর রাতে সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলে গোটা দিন কোথায় ছিল সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওসি জানিয়েছেন, তৃপ্তির মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের জন্য ময়না তদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হবে। তদন্ত রিপোর্ট আসার পর পুলিশ সব কিছু পরিষ্কার হবে। সূত্র: মানবজমিন।