যৌন নিপীড়ন ও ঘুস কেলেঙ্কারি ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহার পদত্যাগ

ই-বার্তা ডেস্ক  ।।  একের পর এক নারী সহকর্মীকে যৌন নিপীড়ন এবং ব্ল্যকমেইল করে ঘুস নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সম্পাদক প্রণব সাহাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেয় ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় ১৭ই আগস্ট পদত্যাগ করেন তিনি। এ নিয়ে নোটিশ জারি করেছে ডিবিসি নিউজের মানবসম্পদ বিভাগ।

যৌন নিপীড়ন

প্রণব সাহার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অনেক পুরোনা এবং লম্বা। ২০১৬ থেকে ২০২৪- এই আট বছর ডিবিসি নিউজে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দেন পাঁচ ভুক্তভোগী নারী। মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন অন্তত ১০ জন।

একজন ভুক্তভোগী নারী ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে লেখেন- “নানা সময়ে বার্তাকক্ষে আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে ঘাড় স্পর্শ করেন প্রণব সাহা। নিষেধ করলেও স্পর্শ করা বন্ধ করতেন না তিনি। ‘হ্যাশট্যাগ মি-টু’ আন্দোলনের সময় কিছুটা সংযত থাকলেও গেল দুই বছর অযাচিত স্পর্শ করার প্রবণতা তার আরও বেড়ে গেছে।”

ভুক্তভোগী নারী ওই অভিযোগপত্রে আরও লেখেন- “আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। কোনটা গুড টাচ আর কোনটা ব্যাড টাচ- তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। ঘাড় ছোঁয়াসহ অযাচিতভাবে শরীর স্পর্শ করাকে কোনোভাবেই ‘স্নেহের স্পর্শ’ বা ‘আমি তো বোনের মতো দেখি’ ইত্যাদি বলে ক্ষমা পেতে পারে না। এ বিষয়ে ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।”

আরেকজন ভুক্তভোগী নারী ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে লেখেন- “নানা সময় শরীরে অযাচিতভাবে হাত দেন প্রণব সাহা। কখনও কাঁধে, কখনও ঘাড়ে, কখনও মাথায়। বারণ করলেও কখনও শোনেননি তিনি। উলটো আরও বেশি বেশি করতেন।”

এই নারী তার অভিযোগপত্রে আরও লেখেন- “এসব বিষয় নিয়ে অফিসকে আগেও একবার জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।”

আরেক নারী অভিযোগ করেন- “প্রণব সাহা কেবল অযাচিত স্পর্শ করেই থামেন না। তার সঙ্গে সেক্স নিয়ে কথা বলতে বাধ্য করেন। পিরিয়ডের সময় কুরুচিপূর্ণ ও ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলতেও ছাড়েননি।”

মি-টু আন্দোলন

যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় মি-টু আন্দোলন। এর আঁচ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে একাধিক পোস্ট দেন, যা ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। যাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে তাদের একজন সাংবাদিক এবং অন্যজন ব্যবসায়ী।

শুচিস্মিতা সীমন্তী হ্যাশট্যাগ মি-টু লিখে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ফেসবুকে প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন- “আমার বয়স যখন ১৬ তখন আমাকে যৌন নিপীড়ন করেন সাংবাদিক প্রণব সাহা। আমার শরীরে বহুবার আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে সবার অগোচরে এই বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম এবং এই ঘটনা আমার হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল।”

এ নিয়ে বিবিসি বাংলাকে সীমন্তী বলেছিলেন- “প্রণব সাহা ফ্যামিলি ফ্রেন্ড ছিলেন। উনি অনেক সময় আসতেন। আমি যখন পড়তাম আমার রুমে আসতেন এবং উনি যেভাবে টাচ করতেন এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অনেকবার এ ঘটনা হয়েছে আমার সাথে। এতবার হয়েছে যে আমি হিসাবই করতে পারব না। চেষ্টা করেছি যাতে এক্সট্রিম কোনো পর্যায়ে না যায়।”

ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করার পর ২০১৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর প্রণব সাহার কর্মস্থল ডিবিসি নিউজে অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে ইমেইল করেছিলেন সীমন্তী। এরপর ডিবিসি নিউজের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তদন্ত চান নারী অধিকারকর্মীদের একটি দল।

এরপর কিছুদিনের জন্য টেলিভশন স্ক্রিনে প্রণব সাহার উপস্থিতি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এক বছর ডিবিসি নিউজকে বয়কট করেন সুলতানা কামাল, খুশী কবিরের মতো নারী অধিকারকর্মীরা।

উল্লেখ্য সীমন্তী অভিযোগ করার এক সপ্তাহ পর ফেসবুকে এক পোস্টে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন প্রণব সাহা।

আর্থিক কেলেঙ্কারি

টার্গেট ব্যক্তির পেছনে পছন্দের রিপোর্টার লেলিয়ে দিয়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অনেক অভিযোগ রয়েছে প্রণব সাহার বিরুদ্ধে।

গেল এপ্রিলে সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানের ভিডিও নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয় দেশের সংবাদ জগতে। ওই ভিডওতে তিনি দাবি করেন, জালিয়াতির তথ্য গোপন রাখতে কয়েকজন সাংবাদিককে ঘুস দিয়েছিলেন তিনি।

শামসুজ্জামানের বক্তব্যে ডিবিসি নিউজের নাম এলেও সাংবাদিকের নাম ছিল না। পরে এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠায় ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ। পরে একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডিবিসির সিইও ও প্রধান সম্পাদককে জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট শামসুজ্জামানের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুস নিয়েছিলেন প্রণব সাহা।

প্রণব সাহার আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে গেল ৬ই আগস্ট ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। অভিযোগপত্রে তিনি লেখেন- “ডিবিসি নিউজের সম্পাদক প্রণব সাহা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমার পিএইচডি গবেষণার কাজে টেলিভশনের মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য তার কাছে গেলে আমার কাছে ২০ হাজার টাকা ঘুস দাবি করে। আমি বাধ্য হয়ে তাকে ওই টাকা দেই। বিষয়টি আমি ডিবিসি নিউজের সিইও ও প্রধান সম্পাদককেও জানিয়েছি। বিয়ষটি আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইলে পাবলিক পোস্ট আকারে দিয়েছিলাম ডিবিসির সিইওকে ট্যাগ করে। কিন্তু তার ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে সশরীরে সাক্ষ্য দিতে আমি প্রস্তত আছি।”

সংবাদ বেচাকেনা

প্রণব সাহার বিরুদ্ধে সংবাদ বেচাকেনারও অভিযোগ রয়েছে। ডিবিসি নিউজের এক কর্মী জানান, অফিস কোনো অ্যাসাইনমেন্ট দেয়নি, মার্কেটিং বিভাগও কিছু জানে না, এরকম অনেক নিউজ অন এয়ার হয়েছে। অতি সম্প্রতি কর্মীদের এ বিষয়ে সিইও ও প্রধান সম্পাদক জানান, এই কাজটি একজনই করতেন। তিনি আর যেহেতু নেই। তাই এগুলো আর হবে না।

বার্তা সম্পাদক মজুমদার জুয়েলের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ

মজুমদার জুয়েলের বিরুদ্ধে ডিবিসি নিউজে জমা পড়েছে অসংখ্য অভিযোগ। ভুক্তভোগী নারীরা জানান, তাকে বরাবরই রক্ষা করেছেন প্রণব সাহা।

ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী এক নারী লেখেন- “কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে মজুমদার জুয়েলের কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমার স্বাস্থ্য নিয়ে বলেছেন, ‘আপনার শরীরে কিছুই নেই, আপনি আন্ডারওয়েট’। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করি কি না এমন প্রশ্নও করেন। সবশেষ আমার হাজবেন্ডের বডি শেমিং এবং শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে নিউজরুমে পর পর চারদিন কুরুচিপূর্ণ ও ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলেন।”

আরেক ভুক্তভোগী নারী অভিযোগপত্রে লেখেন- “বিভিন্ন সময়ে মৌখিকভাবে এবং ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন মজুমদার জুয়েল। সাড়া না দেয়ায় নিউজরুমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে একাধিকবার খারাপ ব্যবহার ও অপমান করেন আমাকে। এসব ঘটনা সিইও ও প্রধান সম্পাদককে সঙ্গে সঙ্গে মৌখিকভাবে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।”

অবশেষে ব্যবস্থা গ্রহণ

আট বছর ধরে ডিবিসি নিউজের মানবসম্পদ বিভাগে সম্পাদক প্রণব সাহা ও বার্তা সম্পাদক মজুমদার জুয়েলের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়লেও শক্ত ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতদিন অভিযুক্ত দুজনকে মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানের সামনে কেবল মৌখিকভাবে সতর্ক করে অভিযোগগুলো শেষ করে দেন সিইও ও প্রধান সম্পাদক এম মঞ্জুরুল ইসলাম।

গেল ১৩ই আগস্ট ডিবিসি নিউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আহসানের সামনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ উগড়ে দেন সব বিভাগের কর্মীরা। সেদিনই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে সিইওকে নির্দেশ দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এরই ধারাবাহিকতায় আনীত অভযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৭ই আগস্ট প্রণব সাহাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেয় কর্তৃপক্ষ এবং তিনি পদত্যাগ করেন। পরদিন মজুমদার জুয়েলকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। তদন্ত শেষে তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছে মানবসম্পদ বিভাগ।