লালবাগ কেল্লার যে সুড়ঙ্গে গেলে কেউ ফিরে আসেন না!
ই-বার্তা ।। মুঘল ঐতিহ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে লালবাগ কেল্লা। ঢাকার ভেতর দর্শনীয় স্থানগুলোর কথা বললে সবার প্রথমে যে কয়েকটা জায়গার নাম আসবে, তারমধ্যে অন্যতম লালবাগ কেল্লা!
তবে নেই আদি কারুকাজ ও সৌন্দর্য। তবে লালবাগ কেল্লার ভিতরে থাকা সুড়ঙ্গ নিয়ে রয়েছে নানা রহস্য। লালবাগ কেল্লার দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের সঙ্গে যুক্ত এ সুড়ঙ্গপথটি। সুড়ঙ্গের পুরনো লোহার গেটে ঝুলছে তালা। সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
শুধু সুড়ঙ্গ নয়, এই বিশাল আকারের প্রাচীন নিদর্শনটি ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত রহস্যগুলোর আজও কোনো স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। আসুন লালবাগ কেল্লার সেই চলিত রহস্যগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক!
দুর্গটির নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লালবাগ কেল্লার নিচে রয়েছে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ। এগুলো সুবেদারদের আমলে তৈরি। বিপদের সময় পালানোর জন্য এসব সুড়ঙ্গপথ তৈরি করা হয়। আর এই সুড়ঙ্গগুলোর মধ্যে এখনো বিদ্যমান রয়েছে একটি। যার ভিতরে কেউ ঢুকলে তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় না।
পরীক্ষা করার জন্য একবার দুটি কুকুরকে শেকলে বেঁধে সেই সুড়ঙ্গে নামানো হয়েছিল। শেকল ফেরত এলেও কুকুর দুটো কিন্তু ফিরে আসেনি।
আবার লোকমুখে শোনা যায়, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পাশেই বুড়িগঙ্গা নদীতে যাওয়া যেত। সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়েই নৌকায় উঠে যাওয়া যেত জিঞ্জিরা প্রাসাদে। আবার নদীর বাতাস অনুভবের জন্য ওই সময়ের সেনাপতিরা এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতেন। তবে এসব কথাকে কল্পকাহিনী বলে দাবি করেছে লালবাগ কেল্লার কাস্টোডিয়ান কার্যালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখানকার এক কর্মচারী জানান, এসব কথার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যুদ্ধের সময় মুঘল সেনারা যখন বুঝতেন পরাজয় কাছাকাছি, তখন তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে দুর্গের দেয়াল পেরিয়ে যেতেন।
এই সুড়ঙ্গ ছাড়াও দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে লালবাগ কেল্লার জাদুঘর নিয়ে। সুরম্য দ্বিতল দরবার হলটিই জাদুঘর। সেখানে স্থান পেয়েছে মুঘল আমলে ব্যবহৃত ১২ মডেলের রাইফেল। হাতে লেখা কোরআন শরিফ। যেন শিল্পীর আঁচড়ে আঁকা প্রতিটি আরবি হরফ। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি হাতে লেখা। সুবেদারদের ঝাড়বাতিগুলো দেখলে যে-কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। এক অপরূপ সৌন্দর্য, সবখানে শৌখিনতার ছোঁয়া। মনে হবে সেটিই আধুনিকতার সর্বশেষ সংস্করণ।
খাবারে ব্যবহৃত সিরামিকসের তৈজসপত্র নিয়ে আছে চমকপ্রদ তথ্য। খাদ্যে ভেজাল কিছু থাকলে ভেজাল উপকরণগুলো ওই থালা-বাটিতে কালো রং ধারণ করত। গোসলখানাটিতে ছিল ঠাণ্ডা ও গরমপানির সুব্যবস্থা। ছিল পৃথক কাপড় পরিবর্তনের ঘর ও টয়লেট। গোসলে ব্যবহৃত পুরো ঘরটি টাইলস লাগানো। এখানেও নকশার অনন্য গাঁথুনি।
লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ পরিচিতি
সুবেদার আজম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকায় একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণে হাত দেন। তখন ঢাকার সুবেদারদের থাকার জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করতে আসা সুবেদাররা ঢাকায় স্থায়ী ভবন নির্মাণে কোনো উৎসাহ দেখাননি। যুবরাজ আযম শাহ প্রথম এই উদ্যোগ নেন। তিনি অত্যন্ত জটিল একটি নকশা অনুসরণ করে দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি দুর্গের নামকরণ করেন কিল্লা আওরঙ্গবাদ। কিন্তু পরের বছর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ফেরত পাঠান। ফলে দুর্গের কাজ অসমাপ্ত রেখে তাকে দিল্লি চলে যেতে হয়।
এরপর সুবেদার হয়ে দ্বিতীয়বারের মত ঢাকা আসেন শায়েস্তা খাঁ। যুবরাজ আযম শাহ তাকে লালবাগ দুর্গের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন। শায়েস্তা খাঁ দুর্গের কাজ পুনরায় শুরু করেন কিন্তু ১৬৮৪ সালে তার অতি আদরের মেয়ে পরিবিবি অকস্মাৎ মারা গেলে তিনি অশুভ মনে করে এর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। এর পরিবর্তে নির্মাণ করেন চিন্তাকর্ষক পরিবিবির মাজার বা পরিবিবির সমাধিসৌধ!
এরমধ্যে লালবাগ দুর্গের প্রায় ১২ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যায়। দুর্গের নিয়ম অনুযায়ী একটি ভূগর্ভস্থ পথও নির্মাণ করা হয়। আত্মরক্ষা কিংবা প্রয়োজনবশত পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণত এ পথ ব্যবহৃত হয়। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালের সঙ্গে যুক্ত আছে এ সুড়ঙ্গ পথটি।
সুড়ঙ্গ সম্পর্কে যুক্তিগত মতামত
স্থাপত্যবিদদের মতে, এ পথটি প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে টঙ্গী নদীর সঙ্গে যুক্ত। আবার কেউ মনে করে, এটি একটি জলাধারের মুখ। এর ভেতরে একটি বড় চৌবাচ্চা আছে। মোঘলদের পতনের পর লালবাগ দুর্গ যখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন ঢাকাবাসীর সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এই সুড়ঙ্গ। আর তখন থেকেই নানা মুখরোচক কাহিনী চালু হয় সুড়ঙ্গটি নিয়ে।
যেহেতু সুড়ঙ্গ পথের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আজ পর্যন্ত প্রত্মতাত্তিক খনন কাজ হয়নি, তাই এটি নিয়ে নানা কল্পকাহিনী চালু আছে। এ কারণেই এ সুড়ঙ্গ পথটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে এক বিরাট রহস্য। তাই আজও এই সুড়ঙ্গের সামনে তারা জড়ো হয়ে দাঁড়ায়। জানমালের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় বা কৌতূহলবশত কেউ যেনো এর ভেতরে প্রবেশ না করে, সেজন্য সুড়ঙ্গমুখে গেট নির্মাণ করে তাতে তালা দেওয়া হয়েছে।