ঋতুপর্ণ ঘোষ- বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন যুগের স্রষ্টা
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৩০শে মে ২০১৭, মঙ্গলবার
| সন্ধ্যা ০৬:১৭
অন্যান্য
আফিফা মোহসিনা অরণি ।। ই-বার্তা ।। কালের নিয়মে উল্টে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা। আরও একটি ঋতুহীন বছর আসে বাঙালির সামনে। চার বছর আগে আজকের এই দিনে আচমকা বেজেছিল শেষ ঘন্টা, চলে গিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার নক্ষত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ। এমন নয় যে শুধু আজকের দিনটিতেই তাঁকে স্মরণ করছি আমরা। তাঁকে বোঝা সহজ নয়, তবে তাঁর মতো প্রতিভাবান, মানবিক একজন মানুষকে ভুলে যাওয়া সত্যিই কঠিন। তিনি জানতেন পুরনো গল্পকে কিভাবে নতুন আঙ্গিকে বলতে হয়।
ঋতুপর্ণের জন্ম কলকাতায় ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট। তার বাবা-মা দুজনেই চলচ্চিত্রজগতের মানুষ ছিলেন। ঋতুপর্ণের মূল আগ্রহ ছিল চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। প্রথমে তথ্যচিত্র দিয়ে শুরু করে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন নব্বইয়ের দশকে। ঋতুপর্ণ ঘোষই একমাত্র পরিচালক যিনি সমগ্র বচ্চন পরিবারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
১৯৯৪ সালে ঋতুপর্ণের দ্বিতীয় সিনেমা ‘উনিশে এপ্রিল’ দিয়েই বাজিমাত করলেন তিনি। দুটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নিলেন, সেইসঙ্গে জয় করেন দর্শকের ভালোবাসা। বাংলা সিনেমার দর্শক যখন ছবিঘর থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তখন নতুন করে তাঁদের হলে টেনে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ।
তিনি যেমন ধরিয়ে দেন বাঙালি জীবনের ‘উৎসব’, তেমনই চিনিয়ে দেন বাঙালির ‘অসুখ’। গতানুগতিক ফর্মুলা বদলে ভিন্ন ধারার এমন একটি সিনেমা দেখে দর্শক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সমালোচকদের প্রশংসা তো কুড়ালোই, বাণিজ্যিক সাফল্যও পেল সিনেমাটি।
ঋতুপর্ণের বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি মারদাঙ্গা অ্যাকশন, নাচ-গানের মতো বিনোদনের পরিবর্তে মানুষের গল্প, মনোজগতের গল্প বলতে ভালোবাসতেন। চলচ্চিত্রের ভাষা তাঁর সিনেমায় ছিল প্রধান। ছোট্ট একটি দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতেন দ্বন্দ্ব। দর্শককে নিয়ে যেতে পারতেন ভাবনার সিঁড়িতে। ঋতুপর্ণ শুধু একজন প্রতিভাবান পরিচালকই ছিলেন না, তিনি চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন সফল। সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি।
যখনই ঋতুর প্রসঙ্গ আসে তখনই একটি কথা শোনা যায়, “ঋতুপর্ণ ঘোষ কি পুরুষ ছিলেন নাকি নারী? নাকি দুটোই ছিলেন?” আবার অনেকের মন্তব্য, ঋতু পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী। কিন্তু ঋতু শুধু মানবিক একজন মানুষ ছিলেন। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়ে বলেছিলেন “শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না”।
ঋতুর আবরণ ও আভরণ নিয়েও কথা উঠেছে অনেক। ঋতুপর্ণ ঘোষ বেশ বছর কয়েক ধরেই ‘ইউনিসেক্স’ পোশাক পরতেন। যেটি সালোয়ার-কামিজ নয়, প্যান্ট-শার্ট নয়, আবার পাঞ্জাবি-পাজামাও নয়। সেটি একান্তভাবেই ঋতুর পোশাক, যা কেবল তাঁকেই মানায়।
ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিসে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রা রোগ ছিল বলে তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু হরমোনাল চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাঁর অসুস্থতা বেড়ে যায়।
ব্যক্তিজীবনে ঋতুপর্ণ ছিলেন সমকামী এবং সেকথা তিনি স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ সিনেমায় একজন সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন তিনি। এই ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যই তাঁকে হরমোনাল চিকিৎসা করাতে হয়েছিল।
২০১৩ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতার নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু ঘটে। তবে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন, থাকবেন চিরদিন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি কোনদিনই পূরণ হবার নয়।
পরবর্তী খবর কাল্পনিক গল্পের আলিফ লায়লা