মৃত্যুর সাথে সখ্যতার এক অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ১৪ই আগস্ট ২০১৭, সোমবার
| দুপুর ০২:১৮
ভ্রমণ
ই-বার্তা।। সেখানে প্রতি পায়ে পায়ে করুণ মৃত্যু আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে। একবার পা ফসকে অথবা ভুল জায়গা পা পড়লে ফিরে আসাতো দূরের কথা প্রাণহীন দেহের অস্তিত্ব খুজে পাওয়াও অনিশ্চিত। তারপরও মৃত্যুর খুব কাছে থেকে একে একে চারজন ফিরে আসি সেদিন।
খৈয়াছড়াতে যাওয়া আগের রাতের বৃষ্টি আর সকালের বৃষ্টি মিলে ঝর্ণার পানিকে পূর্বের তুলনাই অধিক ভয়ংকর করে তুলে। তুমুল গর্জন করতে করতে কয়েক শত ফুট নিচে পড়ছে। ঝর্ণার মুল স্রোতের পাশা দিয়ে কোমর সমান পানিতে হেঁটে যাচ্ছি আমি, বিজয়, সজিব, রাসেল, পারভেজ, অভি, শিপু ভাই, আর সাদিয়া আপু। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র সাদিয়া আপু উপরে উঠেছিল। আমাদের ১৩ জনের গ্রুপের বাকিরা নিচে। অন্যান্য গ্রুপের কয়েকশো ভ্রমনকারীর অধিকাংশ নিচে, আমাদের সাথে মাত্র কয়েকজন রশি বেয়ে উপরে উঠেছিল। বৃষ্টির কারণে অন্য দিনের তুলনাই সেখানের পরিস্থিতি অনেক খারাপ ছিল। মাটি, পাথর, রশি সব কিছুই ভেজা আর পিচ্ছিল। কেউ কেউ কিছু দূর ওঠার পর ফিরে আসে নিচে।
পানির স্রোত ছিল আগের তুলনাই অনেক বেশি। ছোট একটু ভুলের কারণে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সে কথা কারও মনেই ছিল না তখন। সবার সামনে ছিল বিজয়, পারভেজ ভাই, আমি। আমার পিছনে অন্যারা। পিঁপড়ার সারির মত একই রেখাপথে যাচ্ছি। হাতের লাঠি দিয়ে পানির নিচের পাথরে অবস্তা নিশ্চিত করে অতি সাবধানে সর্তক পা পড়ছে সবার। তারপরই ঘটেছিল সেই ভয়ংকর ঘটনা। মৃত্যর খুব কাছে যেয়ে ফিরে আসা। কি যে অসহায়ত্ব, অন্ধকার, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তার সে সময়। সব কিছু ঘটেছিল চার, পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে। কি ঘটছে সেটা বুঝার আগেই বুঝে যায় সমনে খারাপ কিছু ঘটছে। হঠাৎ করেই বিজয় আমাদের সামনে দুই পাথরে ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। পারভেজ ভাই বিজয়ের কাছে থাকাই বিজয়ের ধরে টানতে থাকে। স্রোতের টানের তুলনাই পারভেজ ভাইয়ে সে ধরে রাখার চেষ্টা খুবি সামান্য। বিজয় ধীরে ধীরে নিচেই চলে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখ-মুখে আতঙ্ক, মুখের স্বাভাবিক রং নেই, কালো হয়ে যায়, চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পারে অথচ করার কিছুই থাকে না মানুষদের মত। একবারে শেষ মুহূর্তে বিজয়ের শুধু মাথা উপরে। পারভেজ ভাই তখনও ওকে ধরে রেখেছে। আমি তখন পারভেজ ভাইয়ের পিছনে। কিছু না ভেবেই একপা এগিয়ে বিজয়ের হাত ধরা মাত্রই তিন জনই স্রোতের টানে চলে যায়। পারভেজ ভাই পাথরে আটকা পড়ে। তারপর আবার পাথর থেকে ছুটে যায়। এত দ্রুত সব কিছু ঘটছিল যে কি ভাবে কি হয়েছে সেটা বুঝতেই পারেনি কেউ। শুধু কেউ একজন অন্য একজনকে লাঠি দিতে বলেছিল, এত টুকই মনে আছে পারভেজ ভাইয়ের। পরে উপলব্দি করে নিরাপদে আছে সে। দুই পাথরের নিচে কিছুটা জায়গা ফাঁকা থাকার কারণেই বিজয় নিচে চলে যাওয়ার পরও অপর পাশ দিয়ে বের হয়। কি ভাবে সেভ জোনে যায় সেটাও বলতে পারে না। তখন আমি পানির মুল স্রোতে।
প্রথমে পানির চক্রের মধ্যে ফেলে আমাকে ঘুরাছে। আমি বুঝে গেছি হাতে সময় নেই। কিছু একটা করতে হবে, নয়তো মরতে হবে। সে সময় করারও কিছু ছিল না। চক্রাকার পানির মধ্যে একটা ঘুরোন খেয়ে
যখন উপরে দিকে আসি তখন আমার সম্পূর্ণ বডি সোজা ছিল। শান্ত পুকুরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে গোসল করার মত। আলতো করে ডুব দিয়ে যে ভাবে আবার সোজা হয়ে দাড়াই মানুষ। এত দ্রুত ঘুরান খাওয়ার পরও কি ভাবে আমি সোজা হয়েছিলাম ঈশ্বর জানেন। ফিরে আসার প্রথম ভাগ্য ফেবারে ছিল সোজা হয়ে পানির নিচে থেকে উপরে আসা। মৃত্যু তখন অনেকটাই নিশ্চিত।
কারণ আর দুই-তিন ফুট দুরে পাহাড়ের একটা ধাপের সমাপ্তি। পানি কয়েকশো ফুট নিচে পাহাড়ের সবচেয়ে নিচের ধপারে পড়ছে। পানির নিচে থেকে যখন আমার মাথা বের হয় তখন দেখতে পেলাম দুইজন ছেলে পাহাড়ের এ ধাপের একবারে শেষ প্রান্তে পাথরে উপরে বসে। পরে অভি ঘটণা বর্ণনা করতে যেয়ে বলে, "ঐস্থান সাধারনত বসে থাকার মত স্থান না, কেউ বসেও থাকে না"। মনে হল তারা অনেক আগে থেকেই জানতো কি ঘটতে যাচ্ছে। প্রস্তুত হবে বসে বসে অপেক্ষা করছে আমারকে সাহায্য করার জন্য। কারণ সব কিছু ঘটতেছিল ৫-৬ সেকেন্ডের মধ্যে। এত অল্প সময়ে ঘটনা বুঝতে বুঝতেই চলে যায়, সাহয্যের জন্য প্রস্তুত হওয়া তো দূরের কথা। স্রোতে সাথে নিচে পড়ার শেষ মুহূর্তে আমি তাদের দিকে হাত দিতেই দুইজন আমার দুই হাত ধরে টান দিয়ে উপরে তুলে। একে বারে শেষ মুহূতে। সব কিছুর এত সুন্দর টাইমিং হয়েছিল তার একটাই কারণ, সেটা বোধয় আমি বেঁচে থাকবো বলে।
আমাকে যে পাথরের উপরে টেনে তুলা হয়েছিল সে পাথরি ছিল শেষ পাথর। এ পাথেরে পাশদিয়েই কয়েকশত (নির্দিষ্ট করে জানা নেই কত ফুট) ফুট নিচে পাথরের উপরে ঝণর্না পড়ছে। আমাকে বেশি বিস্মিত করেছিল সাহায্যকারী দুজনের ব্যবহার। তাদের দেখে মনে হল এখানে কিছুই ঘটেনি, কিছু হয়নি। একবারে স্বাভাবিক। তাদের ধন্যবাদ দেওয়ার সময় কোন রিয়্যাকশন ছিল না। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল একবারে স্বাভাবিক। আমাদের বিপদের কথা চিন্তা না করে হোক, অন্তত এত উপরে উঠেছে সেটা ভেবেও আনন্দিত হওয়া কথা ছিল, উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই না, এমনকি একটা কথাও বলেনি। আমাদের সাথেই নিচে চলে আসে। পরে আর তাদের খুঁজি নি, দেখাও হয়নি।
আমাদের তিন জনের বিপদ কাটতে কাটতেই আবার সজিবও একই পরিস্থিতির শিকার। আমাদের বিপদের কথা ভাবতে ভাবতে নিজের খেয়াল রাখেনি। পা ফসকে স্রোতে পড়ে যায়। সাথে সাথে শিপু ভাই ধরে ফেলে। ঘটনা বর্নণা করতে যেয়ে পার্ভেজ ভাই বলে, পতাকা বা কাপড় বাধাঁ অবস্থায় বাতাসে যে ভাবে উড়তে থাকে ঠিক একই ভাবে সবিজকে স্রোত টেনে নিচ্ছে। পিছনে শিপু ধরে রেখেছে। তখন পাশ থেকে এসে রাসেল অপর হাত ধরে। পরে দুইজনে মিলে টেনে তুলে। মুহূর্তে মধ্যে নীরবতা নেমে আসে। যেখানে মাত্রই হইহুল্লো করে কাটছিল সেখানে কেমন যেনও একটা থমথমে ভাব। শেষ পর্যন্ত নিরাপদে নিচে তারপর ঢাকা ফিরে আসি।
একদিকে বৃষ্টির মধ্যে রশি বেয়ে বেয়ে পাহাড়ের ওঠে ঝর্ণার সাথে সখ্যতা যেমন আনন্দদায়ক তেমনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা বেদনাদায়ক হতে পারে কিন্তু সেটাও অধিক আনন্দময়। রুমির একটা কথা দিয়েই শেষ করি, some beautiful paths can not be discovered without getting lose.
আকরাম হোসেন
১০-১১.৭.২০১৭ খৈয়াছড়া ভ্রমণ
পরবর্তী খবর পৃথিবীর সবথেকে রোমান্টিক ১০ শহর