দেনাপাওনা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ২১শে নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার
| দুপুর ০১:১১
গদ্য
পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপ-মায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিলেন নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনও শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুর-দেবতার নামই প্রচলিত ছিল- গণেশ, কার্তিক, পার্বতী তাহার উদাহরণ। এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামস্বন্দর মিত্র অনেক খোজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদী ঘর বটে। বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল। রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন, এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড় করা যায় না। কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। অনেক বাধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল। এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে। অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত স্বদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল, কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না। বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল। রামন্বন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয় টাকাটা শোধ করিয়া দিব”। রায়বাহাদুর বলিলেন, “টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না”। এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে, চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব একটা ভক্তি কিম্বা অনুরাগ জন্মিতেছে, তাহা বলা যায় না।
দেনাপাওনার ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল। সে বাপকে বলিয়া বসিল, “কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না, বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইব”। বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলে “। দুই-একজন প্রবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, “শাস্ত্রশিক নীতিশিক্ষা একো নুই কাজেই”। বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন।
বিবাহ একপ্রকার বিষঃ নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হুইয়া গেল। শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না। নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা”। রামসুন্দর বলিলেন, “কেন আসতে দেবে না, মা। আমি তোমাকে নিয়ে আসব”। রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তার কোনো প্রতিপত্তি নাই। চাকরগুলো পর্যন্ত তাহাকে নিচু নজরে দেখে। অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাচ মিনিটের জন্য কোনোদিন বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন বা দেখিতে পান না। কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া আর অপমান তো সহ যায় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন, যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে। কিন্তু যে ঋণভার কাধে চাপিয়াছে তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি পড়িয়াছে এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে হইতেছে।
এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠতে বসিতে মেয়েকে খোটা লাগাইতেছে। পিতৃগৃহের নিন্দ শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাড়াইয়াছে। বিশেষত শাশুড়ির অক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না। যদি কেহ বলে, “আহ, কী ঐ”। বউয়ের মুখখানি দেখিলে ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে, “শ্ৰী তো ভারি। যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্ৰী”। এমনকি, বউয়ের খাওয়াপারও স্বত্ব হয় না। যদি কোনো দয়াপরতা প্রতিবেশিনী কোনো ক্রটির উল্লেখ করে, শাশুড়ি বলে, “ওই ঢের হয়েছে”। অর্থাৎ, বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন পাইত। সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই, ফাকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে।
বোধ হয়, কন্যার এই সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে। তাই রামকুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহদের নিকট হইতে গোপনে, রাখিলেন। স্থির করিয়াছিলেন, বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়িই ভাড়া লইয়া বাস করিবেন। এমন কৌশলে চলিবেন যে, তাহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পরিবে না। কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল। সকলে আসিয়া কাদিয়া পড়িল। বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো বা সস্তান আছে। তাহাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাড়াইল। তখন রামস্থদের নানা স্থান হইতে বিস্তর স্বদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন। এমন হইল যে, সংসারের খরচ আর চলে না।
নিরুপমা বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। বৃদ্ধের পক কেশে, শুষ্ক মুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্থ এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অম্বতাপ কি আর গোপন রাখা যায়। রামমুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের সাক্ষাংলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে তাহা তাহার হাসি স্ট্রে স্ট্রে প্রাঙ্গ ৰাষ্ট্র। সেই ব্যথিত পিতৃত্বকে সাধনা দিবার উদেশে দিনকতক বাপের বাড়ি নাইবার জন্ত নির নিতান্ত শ্ৰী ইষ্টা উঠিয়াছে। বাপের মান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না। একদিন রামন্বন্দরকে কহিল, “বাবা, আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও”। রামসুন্দর বলিলেন, “আচ্ছা”। কিন্তু তাহার কোনো জোর নাই। নিজের কন্যার উপরে যে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তায় সে পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক মাধিতে হইছে। কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাহাকে না আনিয়া কেমন কবিয়া থাকে, তাই বেহাইয়ের নিকট সে সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো। নোট কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাধিয়া রামস্বন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন। প্রথমে হান্তমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন। হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার আঙ্কোপাস্ত বিবরণ বলিলেন, নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের স্বখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দ করিলেন। শহরে একটা নূতন ব্যামো আসিয়াছে, সে সম্বন্ধে অনেক আজগবি আলোচনা করিলেন। অবশেষে স্থ কাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন, “হঁ। হা, বেহাই, সেই টাকাটা বাকি আছে বটে। রোজই মনে করি, যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই, কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না। আর ভাই, বুড়ো হয়ে পড়েছি”। এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন। সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্ত করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “থাক বেহাই, ওতে আমার কাজ নেই”। একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না। এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি নিবার প্রস্তাব কাহারও মুখে আসে না। কেবল রামন্বন্দর ভাবিলেন, সে সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না। মর্যাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন। রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, “সে এখন হচ্ছে না”। এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন।
টাকাগুলি চাদরের প্রাস্তে বাধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না। বহুদিন গেল। নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না। অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল। তখন রামন্বন্দরের মনে বড়ে আঘাত লাগিল, কিন্তু তবু গেলেন না। আশ্বিন মাস আসিল। রামম্বন্দর বললেন, এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি-। খুব একটা শক্তবুকম শপথ করিলেন। পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রাস্তে গুটিকতক নোট বাধিয়া রামস্বন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল “দাদা, আমার জন্যে যাচ্ছিস?” বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই, তাহ মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনি আসি কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই। রামস্বন্দর তাহ জানিতেন, এবং সে সম্বন্ধে তামাক থাইতে খাইতে বুদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। কিন্তু তাহাতে তাহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই।
দৈন্তপীড়িত গৃহের ক্ৰন্নধ্বনি বানে লইয়া বৃদ্ধ তাহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন। আজ তাহার সে সংকোচভাব নাই, দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলঙ্গ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে, যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন। শুনিলেন, রায়বাহাদুর ঘরে নাই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে। মনের উচ্ছাস সম্বরণ করিতে না পারিয়া রামন্বন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। কি আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বাপও কাদে, মেয়েও কাদে, দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না। এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল। তার পরে রামম্বন্দর কহিলেন, “এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি, মা”। এমন সময় রামস্থলবের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তাহার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহঁস ঘরে প্রবেশ করিলেন। পিতাকে বলিলেন, “বাবা, আমাদের তবে এবার ভুলে যান”। অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলে, “তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব। আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে”? রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন। ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায় তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কিন্তু তবু তাছার জানিয়াছে দেখিয়া তাহদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত কষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। তাহার নাতি তাহার দুই হাটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “দাদা, আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না”? নৃতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া বলিল, “পিসিমা, আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে”? নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, “বাবা, তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছুয়ে বললুম”। রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর, এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান, আর তোরও অপমান”। নিরু কহিল, “টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না। তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না”। রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা”। নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলে। তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ে না”।
রামসুন্দর কুম্পিত হস্তে নোটবাধা চাদরটি কাধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু রামসুন্দর এই যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতুহলী দাসী নিরুর শাশুডিকে এই খবর দিল। শুনিয়া তাহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না। নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল। এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে এবং পাছে সৰ্গদোষে ইনত শিক্ষা হয় এই ওরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নির সাক্ষাৎকাৰ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর অসুখ হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কাতিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই। আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না। সে যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না। যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন তবে শাশুড়ি বলিতেন, “নবাবের বাডির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না”। কখনো বা বলিতেন, “দেখো না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে”। রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন বলিলেন, “ওঁর সমস্ত ন্যাকামি”। অবশেষে একদিন নির সবিনয়ে শাওঁড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা”। শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল”।
কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না, যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল, এবং সেই দিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল। বাড়ির বড় বউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রতিমাবিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরীদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে, বড়ো বউয়ের সংকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল। এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনও দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল ব্যুবুহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব, এবং শুনা যায়, ইহাতে তাহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল। রামস্থদেরকে সাস্তুনা দিবার সময়, তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল। এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল, “আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে”। রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, “বাবা, তোমার জন্যে আর একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে”। এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়। ১২৯৮
আগের খবর উপলব্ধি -পুনম মায়মুনী
পরবর্তী খবর গিন্নী- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর