মোমের পুতুল
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৩রা এপ্রিল ২০১৭, সোমবার
| রাত ১০:৩৭
গদ্য
রাকিবুল ইসলাম
ঢাকা থেকে ৩৬৪ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত দিনাজপুর জেলার অধীনস্থ বিরামপুর থানা এলাকার ঘটনা। বিরামপুর একরকম মফস্বল শহর। সদর এলাকার সুযোগ সুবিধা এখনও পুরোপুরি পৌঁছেনি সেখানে। জীবনমান সেখানে এতটা উন্নত হয়নি। তবে সিটি শহর বলে আজকাল অনেকেই দাবিদার। এই যেমন প্রায় ই এখন জেলার দাবিতে মিছিল কিংবা সমাবেশ হয়ে থাকে। জনমত ও জনবল আগের থেকে অনেকটাই দৃঢ় হয়েছে সেখানে।
সেই মফস্বল শহরের এক মোটর মেকানিক সাজ্জাদের জীবন নিয়েই এ লেখা। সমাজের এত মানুষের ভীড়ে কখনও কখনও সামান্য মানুষ ও যেন কিভাবে অসামান্য হয়ে ওঠে। তারই এক উদাহরণ স্বরূপ মোটর মেকানিক সাজ্জাদ।
তবে সাজ্জাদের জীবনের গল্প যে খুব বেশি ভিন্নধর্মী ঠিক তা নয় তবু খানিকটা হলেও ভিন্ন।
দু মাস আগেই সাজ্জাদের সাথে বিয়ে হয়েছে নিকটবর্তী এক গ্রামের মেয়ে পুতুলের সাথে। শ্রমিক সমাজের প্রায় বেশিরভাগ মানুষের প্রেমই শুরু হয় বিয়ে নামক সম্পর্ক দিয়ে। শতভাগ নয়।
বিয়ে কতক মেয়েকে স্বাধীনতা আবার কতক মেয়েকে দেয় বন্দীত্ব। তা মূলত নির্ভর করে সংসারের স্বামী তথা কথিত পুরূষ শাষিত সমাজের বিবেক পুরূষ জাতির ওপর। তবে পুতুল যে স্বাধীনতা পেয়েছে এক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বাবার সংসারে পুতুল যে শ্রম দিয়েছে তার সবটাই কিছু কিছু পারিবারিক কারণে মূল্যহীন।
সাজ্জাদ যেহেতু একজন ব্যস্ত শ্রমজীবী মানুষ, শহুরে মানুষের মত অতটা কাব্যিকভাবে প্রেম নিবেদন করতে না পারলেও কিছু পুরনো গান দিয়ে খুব সহজেই প্রেম নিবেদন করতে পারে।
প্রতিদিনের মতই আজও দুপুরে বাড়ি ফিরে পুতুলের উদ্দেশ্যে গান গাইল, "চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই......
শুনে পুতুল লজ্জায় মুখ ঢাকলো। সাজ্জাদ রোজ দুপুরেই খাবার খেতে বাড়ি আসে। বিয়ের পর পুতুল কে পেয়ে এখন তার মনে বেশ রঙ লেগেছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে সময় প্রায় ই মনে মনে গুনগুন করে গানও গায়। লোকে কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরবিহীন হাসতে হাসতে চলে যায়।
সাজ্জাদ হাত মুখ ধুুয়ে খেতে বসলো। পুতুল একে খাবার সব এগিয়ে দিল। কিন্তু খাবারের প্রথম গ্রাস পুতুলের মুখে না দিয়ে সাজ্জাদ তো নিজে খাবেনা। পুতুল মাঝে মাঝে দু একবার না করলেও সাজ্জাদ তা শুনলো না।
পুতুল খুব সাদামাটা মেয়ে। রূপ খুব বেশি নয় তবে কি যেন একটা আকর্ষণ আছে তা প্রকাশ করা যায় না। আবার সবাই তা বুঝতেও পারে না। চুলে মাঝে মাঝে রঙিন ফিতে পরলে দারূণ দেখতে লাগে তাকে। প্রথম দিকে পুতুল সাজ্জাদ কে আপনি আপনি বলতো, কিছুদিন হলো তুমি বলা শুরু করেছে।
সাজ্জাদ খাওয়া শেষ করে পুতুলের শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে আবারও তার কাজে চলে গেল।
এমনই মোটামুটি রোজকার সংসার তাদের। পুতুল আবার ফুচকা খেতে ভালোবাসে বলে সাজ্জাদ দু একদিন পরপরই তার জন্য ফুচকা নিয়ে বাড়ি আসে।
পুতুলের এমন সুখের সংসার দেখে আশেপাশের বাড়ির মহিলারা প্রায়ই পুতুলের কাছে গল্প করতে এসে কেউ কেউ নিজের অকর্মণ্য স্বামীর কথা বলে পুতুলের সুখকে অনেক বড় করে তোলে। বলে তুই বড় সুখী রে..........। এমন স্বামী কপাল ছাড়া আর কিছু না। এই সমস্ত প্রশংসা আর কি।
মাসে একবার সাজ্জাদের এক মামাতো ভাই স্বপন বেড়াতে আসে। গল্প গুজব আর সুখ দুঃখের আলাপে বেশ কাটে সময়।
বিশ্বাস........... মানুষের মাঝে আত্মার বাঁধন।তবে বিশ্বাস গড়তে যত সময় ই লাগুক না কেন তা ভাঙতে এক মূহুর্তও লাগেনা।
বিয়ের তিন বছর পার হলো কিন্তু পুতুলের কোন সন্তানাদি হলোনা। বিষয়টি নিয়ে সাজ্জাদের মনে গভীর চিন্তা লেগে থাকে প্রায়ই। কিন্তু পুতুলকে কিছু বলেনা কখনও। পার হলো আরও ছয় মাস। তেমন কোন নতুন খবর নেই।
ভাঙনের সুর এমনই হয়। তার আভাষ ইঙ্গিত সবই থাকে কিন্তু কিছু করার থাকে না।
দু চার দিন হলো সাজ্জাদের আচরণ একটু অস্বাভাবিক লাগছে। পুতুলের সাথে আগের মত আর কথা বলেনা। রোজ দুপুরে খেতেও আসেনা, আরও কিছু..........
দিন চলছিল নিরস , প্রেমহীন এক অভ্যাসপূর্ণ গতিতে। এরপর হঠাত্ এক রাতের কথা, সাজ্জাদ খাবার সময় হঠাত্ বললো। বলার আগেও বেশ কয়েকবার আমতা আমতা করলো এবং শেষমেষ বলেই ফেলল, আমি আবার বিয়ে করতে চাই।
শুনে পুতুল বেশ চমকিত হয়েও চুপ করে রইল।
সাজ্জাদ আবারও বললো তোমার তো ছেলে মেয়ে হবে বলে আর মনে হয় না। বিয়ে আমাকে আরেকটা করতেই হবে।
এমন কথা বলল সাজ্জাদ কিন্তু পুতুল কোন উত্তর করলনা, নিরবে শুধু কাঁদলো।
কাজে আর সাজ্জাদের একদমই মন নেই। কিছুই আর ভালো লাগেনা। পুতুলের জন্য শুধু চিন্তা হয়। মনে হয় সেদিন ওভাবে পুতুলকে বলাটা ঠিক হয়নি। শুনে ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল। এমনই দু চারদিন সাজ্জাদ শুধু ভাবলো কিন্তু পুতুলকে একবারও কিছু বললোনা।
এরপর একদিন সাজ্জাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত করল আজ সে পুতুলকে বলবে যে তার ভুল হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। আজও অবশ্য ফুচকা নিল পুতুলের জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল সাড়া শব্দহীন নিষ্প্রাণ একটি বাড়ি।কোথাও কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। ঘরের দরজায় খিল আটকানো। সাজ্জাদ দরজা ভেঙে ভেতরে মুখ বাঁধা অবস্থায় পুতুল ফ্যানের সাথে ঝুলছে।
প্রেম মানুষের মৃত্যুর ভয়কে করে তোলে সামান্য কিন্তু প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় মনকে বিরতিহীন তাড়া করে....।
আগের খবর মুকুলিমা কিংবা জলপূর্ণিমার গল্প
পরবর্তী খবর তাহার যত কথা