প্লাম ব্লসম
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৯ই এপ্রিল ২০১৭, রবিবার
| সন্ধ্যা ০৭:৩৬
গদ্য
মির্জা ইন্তি
আজ ভ্যালেরিনা চলে গেল। যাওয়াটা নিয়তিই ছিল, আমিই শুধু সময়কে গঙ্গায় ফেলেছিলাম আর...... আর তা পরে তুলে নিতে ভুলে গেছি। জেম,সেন হলের যে ধারটায় মনসার মন্দির ছিল; যেখানে কান্তি দা’র দোকানের পরোটা চিবুতে চিবুতে মাস্টারদা সূর্য সেন আর প্রীতিলতাদের ব্রিটিশ খেদানো বিপ্লবের চিন্তার সূত্রপাত , আমার ৩২০০ টাকা ভাড়ার ছোট্ট ঘরখানা সেই ইতিহাস পেরোনো কান্তি দা’র ছোট্ট দোকান খানা মাড়িয়ে গড়ে তোলা “ শকুন্তলা “ নামের ১১ তলা বিল্ডিংটির একদম চূড়ামণিতে। আসলে ঘর না বলে দু’ খানা কামরার একটি ষ্টোর রুমও বলা যেতে পারে । ১০ ফিট বাই ০৮ ফিট, এখানেই থেকেছি গত আড়াইটা বৎসর। দু’দিনের বেশি বৃষ্টি হলে দেখেছি দেয়াল চুপসে পানি নেমে গিয়ে ঘর আর বাথরুমের মেঝের আর্দ্রতাজনিত পার্থক্য ঘুছিয়ে দিয়ে আমায় প্রবল ভাবে জানিয়ে দিত, খুব বেঁচে আছি এবেলা। আমি চুপচাপ, ভ্যালেরিনাও তাই। ঘরের সামনে ফুট আটে’ক জায়গা খালি পড়ে আছে, তার একপাশটা বাঁচিয়ে ভ্যালেরিনার সখের উদ্ভিত চর্চা । গাছ বলতে তেমন কিছুই ছিল না ;রুগ্ন দুটো টিউলিপ চারা, একটা সদ্য ফোটা জবা আর দু’খানা “প্লাম ব্লসম” । কতবার বলেছি এই প্লাম ব্লসম’খানা এ যাত্রায় আর বেঁচে উঠছে না। কেন মশায় খালি খালি এক অস্তিত্তের অযথা উৎপীড়ন ? তার সে এক কথা, “ ভালো লাগে, তাই।” ও আমি সব বুঝি। এ কোন ভালো লাগালাগি নয়। একে বলে “ পিছুটান”। বছর পাঁচেক আগে যখন ভ্যালারিনার সাথে আমার প্রথম দেখা, তখন আমরা দুজনই জিংজুয়ানে রেলের যাত্রী। সাংহাই পৌঁছেছি তখন সবেমাত্র ৩ মাস বা তারও কিছু বেশি। ইতিমধ্যেই আমি আমার জন্যে দু’ কামরার এক ছোট্ট বাসা গুছিয়ে নিয়েছি সান-চির কিছু অদূরেই। ওটা জিংজুয়ান সাবওয়ের কয়েক ব্লক সামনে, মেইন রোডের যে পাশটায় কৃত্রিম সল্ট লেকটা আছে, তার ঠিক বাপাশে। আমাদের সরকারী কোলনী গুল যেমন হয়,অনেকটা দেখতে তেমনই। মাঝখানে বিশাল মাঠ। চারপাশে পুরানা রঙ ওঠা উঁচু নিচু বিল্ডিং। শুধু মাঠের মাঝখানে এক বিশাল উঁচু প্লাম ব্লসম। প্লাম ব্লসম হল চাইনা দেশের সবচেয়ে প্রতীকী ফুলের বৃক্ষ। শুধু ফুলই নয়, অনেক চাইনিজই এটাকে তাদের ঐতিহ্য বলতে দ্বিধা করে না। সারা বছর এই গাছে কোন ফুলের দেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু, শীতে যখন চারপাশ ফুল শূন্য হয়ে ধরা দেয়,তখন ই মৃতের দেশের বুক থেকে এক ফালি রক্ত এনে গাছে গাছে বেঁচে ওঠে এই নেশাখোর ফুলটি। আমি এখানে অনেক স্থানীয় দাদুদের কাছে শুনেছি, চাইনিজ মিথে আছে – চাঁদ হল ঈশ্বরের সবচেয়ে পছন্দের কন্যা। তার আরও দু’ কন্যা আছে। তো হল কি চাঁদের সেই রাজকুমারী তিনি প্রায়ই সন্ধ্যায় নেমে আসতেন পৃথিবীর মাটির একদম কাছকাছি। কারণ, সে সময়ে চিন দেশের কোন এক মাঠে এক চাষি বাঁশি বাজাত। যার শব্দে হুওয়াঙহো নদীর পানি থেকে মাছ ভেসে উঠত, খাবারের সন্ধানে বের হওয়া পিঁপড়া পথে দাঁড়িয়ে পড়ত, আর মানুষজন কাজ ফেলে তন্দ্রায় ঝিমুত। তো হল কি চাঁদ কুমারী সে পুরুষের প্রেমে পড়ল, পুরুষের দশাও তাই। দু’জনের এই অবস্থা দেখে ঈশ্বর তাদের নিজ সভাস্থলে ডেকে আনলেন এবং পুরো ব্যাপারে তারা তাঁর কাছে কি চায় তা জানতে চাইলেন। চাঁদ কুমারী ছিলেন বয়সে কাঁচা। তিনি পিতাকে অনুরোধ করলেন যাতে চীনা যুবুকটিকে অমরত্তের ক্ষমতা দেয়া হয়। তাহলে তারা আজীবন একই সাথে পাশাপাশি বেঁচে থেকে কাছে থাকতে পারবে। ঈশ্বর মৃদু হেসে কবুল বললেন। এরপর দিন গেল, মাস গেল। তাদের প্রেম হল গভীরতর । ধীরে ধীরে চীনা মানবের বয়স বাড়তে থাকল। মাথার চুল সাদা হয়ে এল, একসময় চুলহীন মাথায় টাক ভেসে উঠল, গায়ের খয়েরী চামড়ায় ভাঁজ পড়ল। সে ধীরে ধীরে কদাকার হতে শুরু করল। এমনকি জীবনে আত্মিক শক্তির অভাবে সে বাঁশি বাজানো ও ভুলে গেল। কিন্তু চন্দ্রকুমারীর যৌবন সেই স্থির সময়ে অপেক্ষারত। যে চন্দ্রকুমারীর আশীর্বাদে সে আজীবন বেঁচে থাকার অধিকার লাভ করেছিল, তা এখন পৃথিবীর সর্বশেষ বোঝা হয়ে তার জীবনে উপস্থিত হল। আর সে নিরুপায়। চন্দ্র কুমারী তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। ধীরে ধীরে সে শক্তিহীন হয়ে চলার ক্ষমতা হারাল এবং তাঁর স্থির শূন্য দেহ থেকে শিকড় গজিয়ে তাঁর থেকে এক শীতের সকালে প্লাম ব্লসম বৃক্ষের রুপ দিল। তাঁর বুকে আজীবন যে কাম, ক্রোধ, ভালোবাসা বেঁচে আছে, তা এই ফুলের রুপে সে পৃথিবীকে উপহাস করে জানাতে লাগলো। এইহল মদ্দা কথায় প্লাম ব্লসমনামা সূচনার ইতিহাস। আমার তাতে থোড়ায় কেয়ার ? তখন নিদারুণ অর্থকষ্টে এর মধ্যেই জেনে গেছি বিগত সভ্যতার আরও কিছু গোপন ইতিহাস। শহরের ভিতর ট্রামের আলোয় বার দু’য়েক খুঁজে নিয়ে ধরাতে হয়েছে ট্রাম থেকে ছুঁড়ে ফেলা যাত্রীর আধপোড়া সিগারেট। পকেট কাঙালি। শহরটা তখনও আমার কাছে নারীর মত। যেন একটা “অন্য” দেহ; যেটা আমার চেয়ে ভিন্নতর ,যদিও মানবিক আবেদনগুল সমস্তটাই যেন অনুরূপ। অনেক ঘুরে এক সার্কাস দলের মিউজিক ব্যান্ডে আপদকালীন গিটারিস্ট হিসেবে ঢুকে পড়লাম। বিনিময়ে দলের সমকামী ম্যানেজার কিমের সাথে আমাকে হেংশা রোডে তার দু’কামরার ছোট্ট এপার্টমেন্টটিতে কাটাতে হয়েছে তিন রাত। যখন জীবিকার প্রয়োজন শেষে কিম এলিয়ে দিয়েছে দেহ বিছানায়, আমি এক কাপ কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম তার ৩৬ তলা উঁচু এপার্টমেন্টের শেড বিছানো বারান্দায়। কোন কিছুই যেন আর কোন অর্থবহন করে না । নিচের পৃথিবী তখনও নির্ঘুম। লাল, নীল, হলুদ,সবুজ নিয়ন আলো জ্বলছে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু এপার্টমেন্ট, নাইট-ক্লাব আর ঝার-বাতির দোকানের বাতিদানে । বৃষ্টি পড়ছে গুড়ি গুড়ি। পিচ ঢালা পথে সে বৃষ্টি ধোঁয়া নিয়ন প্রতিফলিত হয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আরও যেন বহু মাত্রায়। দু’ একটা এলেবেলে পাথুরে কুকুর ঐতিহ্য মেনে রাস্তার উপর ঢুলছে। কিছু আবার মোড় থেকে খানিকটা দূর এগিয়ে কোন এক পথচারীর ফেলে যাওয়া হ্যামবার্গারে খুঁজে নিচ্ছে দিনের প্রথম খাদ্য। এক নেশাখোর অর্বাচীন তখন মঞ্চে। এলোমেলো টালমাটাল পা জানে না তার নিশ্চিত গন্তব্য। কিছু দূর ডানে-বামে হেঁটে সে রাস্তার ধারে এক উঁচু ল্যাম্পপোষ্টের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। চুপচাপ কিছুক্ষণ। সময়ের এই মুহূর্তটিকে যেন আরও প্রবল ভাবে বাঁচিয়ে তুলতে,পাশের বাড়ীর ভাঙ্গা সানসেট মাড়িয়ে “মেউ মেউ” রব তুলে আরও কিছু আফিমখোর বিড়াল সমিতির আগমন। পরিস্থিতি নাটকীয়। পিছনে দূরে কোথাও একটানা বেহালার শব্দ কানে আসছে। কোন বিদেহী আত্মা আজ যেন উত্মত্ত। নেশামুগ্ধ অর্বাচীন তার কাঁধের ঝোলা চিরে বের করে আনল এক “প্রায় শেষ” কাঁচের বানানো বোতল। তারপর তার ছিপিখানা খুলে একটা হাত ডুবিয়ে দিল তার প্যান্টটির বাম পাশের পকেটে। কিছু যেন খুঁজল, যা কখনই পাওয়া যাবে না। এরপর আবার ডানের পকেটে। ............... কেটে গেল একযুগ। এরপর সে একখানা দলা পাকানো প্লাম ব্লসম প্যান্ট এর ভিতর থেকে তুলে নিয়ে গুঁজে দিল খোলা বোতলের ভিতরে। এরপর ধীরে সুস্থে ছিপিটা লাগিয়ে মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ২২ তলা বিল্ডিংটির দিকে তাকাল। কিছু যেন ভেবে নিল সে । বিল্ডিংটার পাঁচ তলায় এখনো বেশ আলো জ্বলছে। বেহালার শব্দটাও ওখান থেকেই আসছে, এখন বুঝেছি। অর্বাচীন নেশামুগ্ধ ছেলেটি তখন তার হাতে ধরে থাকা বোতলটি ছুঁড়ে মারল সেই আলো জ্বলা ঘরটিতে। ঝুপপ, ঝিচচচচ। জানালার কাঁচ ভাঙ্গল। বেহালার শব্দও থেমে গেল অনেকক্ষণ পর। পৃথিবী শব্দ শুন্য এখন । এরমধ্যেই পাঁচ তলার বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। অর্বাচীন তখন উপরে তাকিয়ে দুঃখিত স্বরে বলে উঠল,
“ Sorry Marla ! I thought it is our anniversary today !” এরপর সে কিছুই হয় নি এমনভাবে তার ঘাড় দুটো ঝাঁকাল। মারলা চুপ। অর্বাচীনও তাই। বিড়াল পাড়ার “মেউ মেউ”ও বন্ধ। এমনকি কুকুরগুলোও হ্যামবার্গার থেকে সরিয়ে ফেলেছে মুখ। ছেলেটি মুখে একটা অপাপ বিদ্ধ শিশুর সারল্য মাখিয়ে বলে উঠল, “ You still look the same, Marla ! ” ব্যাস এ পর্যন্তই। মেয়েটির পিছনের পর্দা গলে তখন এক দৈত্যাকার পুরুষের আগমন। তার খালি গা লোমশ জন্তুর মত জাগ্রত। আকাশী রঙের একটা অ্যান্ডি পরে সে ঠিক দাঁড়াল মারলার পিছনে। এরপর তার লোমশ হাত দুটো জাপটে ধরল মেয়েটির কোমর। অর্বাচীন তখন সামনের রাস্তায় চোখ ফেরাল। তার বহুছিন্ন ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল সেই নিয়ন বিছানো পথে। তার সেই টালমাটাল পায়ে, যারা জানে না তার নিশ্চিত গন্তব্য। পিছনে মারলা তখনো জানালায় দাঁড়িয়ে, তার হাতে তখনো ধরা ছিল দলা পাকানো শতাব্দী প্রাচীন প্লাম ব্লসম।
আগের খবর তাহার যত কথা
পরবর্তী খবর ‘আমি এক বাদামওয়ালা’