জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পর্কে জানুন, নিরাপদে থাকুন


ই-বার্তা প্রকাশিত: ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার  | দুপুর ১২:২৭ মেডিকেল

ই-বার্তা।। নারীর অকালমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ জরায়ুমুখে ক্যান্সার। বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ৩০ শতাংশেরই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের শিকার, আক্রান্তের হার প্রতি লাখে ২৯.৪ জন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর এ দেশে প্রায় ১২ হাজার নারী নতুনভাবে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। সচেতনতাই পারে এই রোগ প্রতিরোধ করতে। লিখেছেন স্কয়ার হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের ডাঃ ফারহানা মোবিন।

- জরায়ুমুখে ক্যান্সার কি ও কেন হয়?
জরায়ুমুখের কোষগুলোর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। এই পরিবর্তন এক দিনে হয় না। জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষগুলো বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হতে কয়েক বছর লেগে যায়। জরায়ুমুখে অনেক দিন ধরে ক্যান্সার-পূর্ব অবস্থা থাকতে পারে। ক্যান্সার-পূর্ব অবস্থা খালি চোখে দেখা যায় না। সাধারণত ৩৫ বছর এবং ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সীদের জরায়ুমুখে ক্যান্সার বেশি দেখা দেয়। এর অবশ্য সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা হয়, যা কেবল অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে জরায়ুমুখে সংক্রমিত হয়ে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়।

- কাদের এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি
১। নিরাপদ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব যাদের
২। বাল্যবিবাহ হলে
৩। অল্প বয়সে, অধিক অথবা স্বল্প বিরতিতে গর্ভধারণ করলে
৪। বহুগামিতা
৫। দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি সেবন
৬। ধূমপান করলে।

- জরায়ুমুখের ক্যান্সারের লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও ধীরে ধীরে অনেক উপসর্গ দেখা দেয়।
১। যোনিপথে অতিরিক্ত সাদা স্রাব
২। বাদামি বা রক্তমিশ্রিত স্রাবের আধিক্য
৩। অনিয়মিত রক্তস্রাব
৪। সহবাসের পর রক্তক্ষরণ
৫। ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার রক্তক্ষরণ
৬। তলপেটে বা কোমরে ব্যথা।


- প্রতিরোধের জন্য করনীয়
জরায়ুমুখ ক্যান্সারমুক্ত রাখতে ৩০ থেকে ৬০ বছরের নারীদের প্রতি তিন বছর পর পর VIA-র সাহায্যে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করা উচিত। ১৮ বছরের পূর্বে যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ২৫ বছর হলেই জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো দরকার। আবার বিয়ের বয়স ১০ বছরের অধিক হলে এবং নিজের বয়স ৩০ বছরের কম হলেও জরায়ুমুখ পরীক্ষা করানো উচিত। এই পরীক্ষাগুলো নির্বাচিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, নির্বাচিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল সহ বিভিন্ন হাসপাতালে করানো যায়। জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা শনাক্ত করা যায়। পরীক্ষাগুলো হলো : Visual Inspection of Cervix (VIA), PAPS Smear, Colposcopy, HPV DNA প্রভৃতি। আবার খালি চোখে জরায়ুমুখ পরীক্ষা করে কোনো গ্রোথ, আলসার পাওয়া গেলে সেখান থেকে বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এছাড়াও যেসব সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে সেগুলো হোলো,
১। নারীদের নিরাপদ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা
২। বাল্যবিবাহ রোধ করে অধিক সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকা
৩। সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার
৪। ক্যান্সারের প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা। বর্তমানে দুই ধরনের টিকা পাওয়া যাচ্ছে। ৯ থেকে ৪৫ বছরের নারীরা এই প্রতিষেধক টিকা নিতে পারেন। তবে ৯-২০ বছর পর্যন্ত (বিবাহ-পূর্ব সময়ে) যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগের সময়টাই টিকা নেওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে এই টিকা দুটি বেশ ব্যয়বহুল।

- চিকিৎসা পদ্ধতি
রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের বিস্তৃতি পরিমাপ করা হয় এবং সেই সঙ্গে জরায়ুমুখ থেকে বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল গ্রেডিং করা হয়। এরপর ক্যান্সারের স্টেজ অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।
জরায়ুমুখের ক্যান্সারের স্টেজ বা পর্যায় তিনটি।
পর্যায় ১ : যখন ক্যান্সার শুধু জরায়ুমুখে সীমাবদ্ধ থাকে।
পর্যায় ২ : যখন ক্যান্সার জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের ওপরে কিছুটা ছড়ায়।
পর্যায় ৩ : যখন ক্যান্সার জরায়ুমুখের সঙ্গে যোনিপথের নিচের অংশে ও আশপাশে ছড়ায়।
পর্যায় ৪ : যখন ক্যান্সার জরায়ুমুখের সঙ্গে মূত্রথলি, মলদ্বার অথবা দূরে লিভার, ফুসফুস, ব্রেইনে ছড়িয়ে যায়।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রতিটি পর্যায়ে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায়। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে অপারেশন করালে রোগ নিরাময় সম্ভব হয়। অ্যাডভান্স স্টেজে কেমো-রেডিয়েশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। জরায়ুমুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার পরও নির্দিষ্ট বিরতিতে রোগীকে সারা জীবন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।

মূলত সচেতনতাই পারে জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে। তাই আমাদের দেশের নারীদের বেশি বেশি করে এই বিষয়ে তথ্য প্রদাণ করতে হবে বিভিন্নভাবে। হতে পারে সেটি ক্যাম্পেইন বা স্কুল-কলেজের শিক্ষায়।

সর্বশেষ সংবাদ

মেডিকেল এর আরও সংবাদ