বাসন্তী রাঙা বাড়ী ও মাধবীলতা
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ১লা অক্টোবর ২০১৭, রবিবার
| দুপুর ০১:২২
গদ্য
“পরিবর্তন” শব্দটা সাধারণত যতটা স্বাচ্ছন্দ্যের সাঙ্গে ব্যবহার করা বা বলা যায়, বিষয়টা যে ততটা সহজ না তা এই প্রথম বুঝলাম বললে মোটামোটি সত্যটাই বলা হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিবর্তনের প্রায় ছোটখাটো পর্বত সমান ভক্ত। কী হবে, না হবে, আদৌ তা গ্রহনযৌগ্য কি না; সামান্য এই সম্ভাব্য বিপদে লুকনো সেই লোমহর্ষক অনুভূতির প্রতি আমার আকর্ষণ একজন নেশাগ্রস্ত যুবকের মাদকের প্রতি আকর্ষণের সমতুল্য। মানুষ হিসেবে নিজেকে পরাজিত মনে হয় যখন সাধারণের বাইরে বা যে পরিস্থিতির মানব মস্তিষ্ক আগে কখনো সম্মুখীন হয়নি এবং সে পরিবেশটিতে স্থির হতে না পারাতে যদিও তা প্রায় অনেক সময়ই, না, ভুল বললাম; সবসময়ই পরিবর্তন অসহনীয় ও বর্ধক কিন্তু তা বলে যে পরিবর্তন একটা একটা করে প্রতিটি জীবকে একটি আশার পথ ধরে সভ্যতার শিখড়ে তুলে নিচ্ছে না তা দাবি করা অনাড়ম্বরভাবে মূর্খতা। আমাকে আবারও বলার অনুমতি দিন, পূর্বে লিখিত সবই একটি মহাপুরুষ হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত একজন মানবের ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি মাত্র।
একটি মাঝারি আকারের বালু নদীর ঠিক আড়াআড়ি একটি হেলানো কৃষ্ণচূড়া গাছের পিছনের সাড়ে সাত বর্গ ফিটের দ্বিতল হালকা মেঠে বাসন্তী রাঙা একটি বাড়ী এবং তার পেছনের ৫০ গজের ছোট্ট বাগানটা আমাকে আশ্রয় ও একটি সুসম বাসস্থান প্রদান করবে বলে গত চার বছর আগে সিদ্ধান্ত নেয়। আমার বন্ধু অর্ণব যখন বাসার লম্বা দানবাকৃতি গেটের সামনে পার্ক করে এবং আমি গাড়ী থেকে নেমে হাতের মধ্যে রাখা মখমলের চ্যাপটা বাক্সটি থেকে “মাধবীলতা” নামের ফলকটি বের করে গেটের পাশের স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা ফ্রেমটার মধ্যে ঢুকাতে ঢুকাতে মনে করলাম, বাবা একবার বলেছিল মনে এক প্রকার অস্তুষ্টি নিয়ে,
"জীবনে, মানুষের একটি সফল সু্ন্দর জীবনে ফিরে আসার সব জোর, মানসিকতা, হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তুমি মাধবীর অনুপস্থিতিতে। তাই হবার সম্ভবনা বাড়িয়ে কারই বা স্বার্থসিদ্ধি করছো তুমি, হিমাদ্রী? সামনে আগানোর চিন্তা না করে তুমি পিছনে যাচ্ছ। পাগলও, জানতাম, নিজের ভালোটা বোঝে।"
বাবার মুখটা হয়ত এখন দেখলে নিজেকে স্বাভাবিক বা ইংরেজিতে যাকে বলে "সেইন" রাখাটা মুসকিল হতো; যদিও তার কথা এক পর্যায় সত্য ছিল। বেশ বড় এবং সূক্ষ্ম করে বলা অর্নিবার্য, এই গল্পে মাধবীলতা নামক নারীটি আমার স্ত্রী। ছিলো বলতে চাচ্ছি না, যদিওবা তার অস্তিত্ত বর্তমানে অজানা; কিন্তু গত ১৫ বছর যার সাথে আমার বসবাস, বড় হওয়া, ভালবাসা, ভালবাসতে শেখা, রাগ, ক্ষোভ, পৃথিবীটাকে কল্পনার তৈরি চশমা দিয়ে দেখা এবং একটি মসৃণ শীতল রাতে আট তলা বাড়ির ছাদে দাড়িয়ে কিছু ক্ষুদ্র, খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব, কয়েকটি আলিঙ্গন, তাকে “ছিলো” বলাটা আমি যতোটা নই, তার থেকে বেশি আত্মকেন্দ্রিক শুনাবে। পরিচয়টা আমাদের তার একটা জল রঙের ছবি আমার কাছে ভুলে চলে আসা থেকে। ভুল বসতো আমার আপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের একজনের কেনা চিত্রকর্ম মাধবী আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। বয়সের ফারাক যে শুধু একটা সংখ্যা। ঘটনাতা আমাদের মাঝে "ভুল রঙ" নামেই চলত।
হটাৎ করে এক বিকেলে ওকে অফিস থেকে পিক করার সময় ও, "এই ধারার সবচেয়ে মহার্ঘ জায়গাটি তুমি আমার জন্য বরাদ্দ করে রেখেছ বলে ধন্যবাদ।" বলেই সে দিলো তার দম বন্ধ করা অত্যুৎকৃষ্ট হাসি, ওর হাতের কাঁচের রেশমি চুড়িগুলোও যেন ড্যাবড্যাবে চোখে অনুকরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে যা তারা পরবর্তিতে একে অপরের গায়ে লেগে বাজিয়ে শুনাবে।
পালিয়ে মেরিজ রেজিস্টারে সই করে কবুল বলার ঠিক এক বছর তিন মাসের মাথায় অন্তঃসত্তা অবস্থায় আমার অজান্তেই আমার প্রথম বই প্রকাশের টাকাগুলো নিয়ে এই জমিটার নিবন্ধন করায়। রাজভোগের আধ কেজি রসমালাই, নিবন্ধিত জায়গার কাগজ, ও আলট্রাসাউন্ডের রিপোর্ট হাতে আমার দু পয়সা রোজগারের জায়গায় এসেই বলে,
"আমাদের বাবু হবে! চলো বাসায় যাই।"
সবার চোখ প্রায় কপালে তাও যদি তা আমাকে ঠেকাই। রিকশায় উঠে রিপোর্ট খুলে দেখতে পেলাম সাদা-কালো ছবিটাতে আবছা তিনটে মাথা। তাই মাধবীর কানে কানে বললাম,
"আচ্ছা, আমাদের বাচ্চার কি এক্সট্রা মাথার প্রয়োজন পরবে? সুদূর ভবিষ্যৎে? নাকি আমার চোখের ভুল? কারণ ছবিতেতো দেখছি অরিজিনাল পিস-এর সাথে কম্পলিমেন্টারি আরো দুটো।"
সটাং! করে মাথার পিছনটায় মাধবীর হাতে সজোরে একটা বারি খেয়ে রিকশা থেকে আধ পড়ে গিয়েও সিটে উঠে বসার সময় বুঝলাম, আমার মতো তালকানা দুর্লভ বেপার এবং আমাদের দুই কক্ষের ঘরে একটা নয়, তিনটে খুদে অতিথি আসছে। (মনে মনে: অবশ্য মাধবী যদি বাচ্চাদেরকে এইভাবেই শাশন করে, তাইলে এক্সট্রা মাথা মাস্ট!)
মাধবীলতা মারা গেছে আজ থেকে প্রায় ৭ বছর হবে। ডেলিভারির সময় অতিরিক্ত ব্লাডলস এর কারনে মারা যায় ও। ওদের মৃতদেহ দেখার মত মুখ আমার হয় ওদের প্রয়াত হয়ার আড়াই বছর পর। ঠিক কেন গিয়েছিলাম, কারনটা এখনো আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
আলিন্দোতে দাঁড়িয়ে যখন দেখছিলাম কর্মীরা কত অবহেলায়, অযত্নে আশবাবপত্রগুলো রাখছিল, মনে করিয়ে দিলো ওর চটে যাওয়া গলার স্বর। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষটার রাগে যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা থাকে, তা সর্ব প্রথম মাধবীর কাছেই আমার জানা। কর্মীদের তাঁদের পর্যাপ্ত অর্থ পরিশোধ করে বাড়ীটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম, অর্ণবকে বিদায় জানিয়ে। তিনটে অন্দরমহল, একটি আলিসান বসার ঘর এবং একটি বিরাট খাবারঘর, সাথে ছাদ। সিঁড়ি বেয়ে কখন উপরে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। দোষ বয়সটাকেই দিলাম, যাও। কয়েকটা বছরে একটি মানসিক পরিচর্যাকেন্দ্র তার একটি রোগিকে পুরোপুরিভাবে মানসিক দিক থেকে অকেজো করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। জায়গাটি শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি জানালাবিহীন ছোট্ট একটি ঘর এবং তার সাথে অমানানসই পাহার আকৃতির ধূসর রঙের খোপ করা দরজা। ইংরেজিতে যাকে বলে "সোলিটারি কনফাইনমেন্ট"। বসবাসের যোগ্য-অযোগ্য বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা একটি ব্যক্তির জন্য তা সত্যি অনেক মর্মান্তিক। তাই আগের বসবাসের জায়গার তুলনায় বাড়ীটা মন্দ নয়।
পশ্চিমমূখি ঘরটিতে একটি তোশক বিছিয়ে রাতটা পার করার পরিকল্পনা করতে যাব, চোখ পরে গেল একটি বাক্সে—আমার আর মাধবীলতার ছবি, ওর নিজের আঁকা, কোণ থেকে ছিঁড়ে গেছে। তখন মনে হলো, কেমন হয় যদি মাধবীর ঘরটা ওর ব্যক্তিগত জিনিশ দিয়ে ভরিয়ে দেই? যেই চিন্তা, সেই কাজ। অন্দরমহলগুলোর একটি সাজিয়ে দিলাম ক্যানভাস, রঙের আধার ও সব প্রকার তুলি এবং বাকি সরঞ্জাম দিয়ে, যাদের গায়ে এখনো মাধবীর গন্ধ আবছা লেগে আছে। আমার লেখা ওকে ঘিরে ২৩টি বইগুলোও গুছিয়ে রাখলাম। মাধবীলতার কিছু আত্মপ্রকৃতি এই ঘরটির দেয়ালে টাঙিয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখলাম এবং বার্জার পেইন্ট-এর বিজ্ঞাপনগুলোর মত আপন মনে ভাবার মত একটা গুরুত্বহীন কাজ করে উপলব্ধি করলাম আর একটি বার, প্রভুর সবচাইতে মূল্যবান সৃষ্টি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন এবং তার যথাযথ মর্যাদায় ত্রুটির কারণে তাকে সসম্মানে ফিরিয়ে নিয়েছেন। এই চিন্তাতেই অবিচল থেকে ঘরটি তালাবদ্ধ করে, চাবিটি পকেটে পুরে রান্নাঘরের উদ্দেশে রওনা হলাম। তালাবদ্ধের কারন? আমাদের স্মৃতি, বিশেষ করে ওর খন্ড খন্ড স্মৃতিগুলো বাঁচার অধিকার অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে; যার পিছনে আছে সারিবিদ্ধ অনেক ছোট্ট কারণ। যদিও আমার এই নতুন জীবনে, নতুন অধ্যায়, নতুন এই বাড়ীতে অতীত নিয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য কিন্তু আমি সেটাকে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে দিতে নারাজ।
নামতে নামতে, সিঁড়ির পাশের বিরাট বিরাট জানালাগুলোতে দৃষ্টি আটকে গেল। আমদের সংসার যে ভাড়া বাড়ীতে হেসে-খেলে-কেঁদে বেঁচে ছিলো, তার প্রত্যেকটি গোমরামুখো ও দেয়ালের তুলোনায় হাস্যকর রকমের ছোট ছিল। ভোরের প্রথম রশ্নি, সুধাকরের এই আছি-এই নেই প্রভা ও ঝড়ের সেই ধুলোবালির কড়া সমীরনের অনুপস্থিতি প্রায়ই মাধবীর মুখকে বাংলার ৯-এর মত করাতো। রান্নাঘরে ঢুকে যখন দেখলাম, কফির কয়েকটা পাতা ছাড়া কিছুই নেই, ফুরফুরে মনটা তারের ছোবা হয়ে গেলো। চাবির পাশেই থাকা এক প্যাকেট সিগারেট আর লাইটার হাতে নিয়েই এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। পরিবর্তন জীবনে এই প্রথম এত ভয়ংকরভাবে আমাকে ভাবালো। হয়তো জীবনে সেইভাবে কখনো কোন পরিবর্তন আসেইনি মাধবীলতার পদার্পণের পর যা আমার জ্ঞানকে নাড়িয়ে দিবে। নতুন বাড়ীর ঘ্রাণ, মাটি, হাওয়া স্বাধীনতারএক পূর্ণ আভাস দিলেও প্রতিটি ঘর একবারের জন্য হলেও আমাকে অর্ধাঙ্গবোধ করাতে পিছু হাটেনি। তাই বুঝি ফাঁকা বাড়ীটা আমার সাথে একাকার হওয়াটা খুব তীব্রভাবে অনুভব করলাম। সূর্য তার শেষ প্রহরের দর্শন দ্বারা আমাদের সৌভাগ্য কামনা করলো, যখন আমার হাতের তৃতীয় সিগারেটের ধোঁয়া তা আড়াল করে দিলো।
-হুমায়রা মোরশেদ
আগের খবর নীল চশমা- ডাঃ ফারহানা মোবিন
পরবর্তী খবর ফেসবুক সমাচার “সুতরাং” - পুনম মায়মুনী