গর্ভকালীন নয় মাস- মা ও শিশুর শারীরিক পরিবর্তন
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ২রা নভেম্বর ২০১৭, বৃহঃস্পতিবার
| দুপুর ০২:১৬
মেডিকেল
ই-বার্তা।। আপনার দেহের ভেতরেই আরেকটা প্রাণ হঠাৎ এসে উপস্থিত। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে সে। সে এক অসাধারণ অনুভূতি, তাই না?
প্রথমে কিছু টের না পাওয়া গেলেও কয়েকদিনের মধ্যেই আপনার শারীরিক পরিবর্তন আসে আর সেইসাথে মানসিক। তারপর মর্নিং সিকনেস। দেখতে দেখতে আপনার বাচ্চা পেটের ভেতরে নড়াচড়া শুরু করে।
গর্ভকালীন নয় মাসের সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যাকে ট্রাইমিস্টারস বলে। প্রতি ট্রাইমেস্টারে আপনার ও আপনার শিশুর দেহে কী ঘটে এটা আগে থেকেই জানা থাকলে আপনি আপনার নিজের দেহের পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকবিহাল থাকছেন। ফলে অযথা টেনশন এড়াতে পারবেন। অন্যদিকে গর্ভের শিশুর গঠন কেমন হচ্ছে তা জানতে পারবেন। আসুন, জেনে নেই গর্ভকালীন ট্রাইমিস্টারে কখন কি হয়।
প্রথম তিন মাস- (মায়ের শারীরিক পরিবর্তন)
একজন নারীর শরীরে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে অল্প কিছু পরিবর্তন ও লক্ষণ প্রকাশ পায়। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে শরীরের প্রতিটা অঙ্গেই প্রভাব পড়ে। পরিবর্তনগুলো বাহ্যিকভাবে প্রকাশ না হলেও শরীরের অভ্যন্তরে হয়। হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বমিবমি ভাব ও বমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারো কারো বিভিন্ন জিনিসের গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা দেয়। এছাড়াও যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হল- অত্যন্ত দুর্বল অনুভব করা, স্তন নরম হওয়া ও ফুলে যাওয়া, পেট খারাপ হওয়া, খাবারে অরুচি বা খুব বেশি ক্ষুধা পাওয়া, মেজাজের পরিবর্তন, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুক জ্বালাপোড়া করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, মাথাব্যথা ইত্যাদি।
(ভ্রূণের বৃদ্ধি)
গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে বাচ্চার হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের গঠন হওয়া শুরু হয়। এই সময়েই বাচ্চার হাত, পা, মস্তিষ্ক, স্নায়ুরজ্জু এবং স্নায়ুর গঠনও শুরু হয়ে যায়। ভ্রূণের আকার তখন হয় একটি মটর দানার মত। দ্বিতীয় মাসে ভ্রূণের আকার বৃদ্ধি পেয়ে শিমের বিচির মত হয়। গোড়ালি, কব্জি, আঙ্গুল ও চোখের পাতা গঠিত হয়। হাড়ের প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে যৌনাঙ্গ এবং অন্তঃকর্ণের বিকাশ শুরু হয়।
দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে ভ্রনের ৮-১০ টি প্রধান অঙ্গ গঠিত হয়। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেশি হয় ও ভ্রূণের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তাই এই সময়ে ক্ষতিকর কোন ঔষধ গ্রহণ করা উচিৎ নয়।
গর্ভাবস্থার তৃতীয় মাসে হাড় ও পেশীর বৃদ্ধি শুরু হয়। ভবিষ্যৎ দাঁতের জন্য ভিত্তি তৈরি হয় এবং হাত ও পায়ের আঙ্গুলের বৃদ্ধি হয়। এই সময়ে অন্ত্রের গঠন শুরু হয় এবং ভ্রূণের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ থাকে।
দ্বিতীয় তিন মাস- (মায়ের শারীরিক পরিবর্তন)
এই সময়ে মায়ের এনার্জি লেভেল কিছুটা বৃদ্ধি পায়। ভ্রুনের বিকাশের সাথে সাথে নারীর শরীরের সামনের অংশের ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে বলে পিঠে ব্যথা হতে পারে। ১৬-১৮ সপ্তাহে ভ্রূণের প্রথম নড়াচড়া টের পাওয়া যায়।
(ভ্রূণের বৃদ্ধি)
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় তিন মাসে গর্ভস্থ ভ্রূণের অনেকটা বৃদ্ধি হয়। এই সময়ে ভ্রুন ৩-৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। ১৮-২২
সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ জানা যায়।
গর্ভাবস্থার ৪ মাসের সময় ভ্রু, পাপড়ি, নখ এবং ঘাড় গঠিত হয়। এই সময়ে ভ্রূণের ত্বক কুঞ্চিত থাকে এবং হাত ও পা বাঁকা করতে পারে। কিডনি কাজ করা শুরু করে এবং প্রস্রাব উৎপাদন করতে পারে। গর্ভস্থ শিশু ঢোক গিলতে এবং শুনতে পারে।
পঞ্চম মাসে ভ্রুন সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মা তার নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন। এই সময়ে গর্ভস্থ শিশু নিয়মিত সময়ে ঘুমায় ও জেগে উঠে। সূক্ষ্ম লোম গজায় যাকে ল্যানুগো বলে এবং ভ্রূণের ত্বকের সুরক্ষায় মোমের আবরণ তৈরি হয়, যাকে ভারনিক্স বলে।
ছয় মাসে ভ্রূণের চুল উৎপন্ন হওয়া শুরু হয়, চোখ খোলা শুরু করে এবং মস্তিষ্কের বিকাশ খুব দ্রুত হয়। ফুসফুস পুরোপুরি গঠিত হয়ে গেলেও কাজ করা শুরু করেনা।
শেষ তিন মাস- (মায়ের শারীরিক পরিবর্তন)
গর্ভাবস্থার তৃতীয় তিন মাসে গর্ভবতী নারীর জরায়ু বড় হয়ে ডায়াফ্রামে চাপ সৃষ্টি করে (ডায়াফ্রাম হচ্ছে বুক ও পেটের মাঝামাঝি অবস্থিত পেশী যা শ্বাস নেয়া ও নিঃশ্বাস ছাড়ার সাথে জড়িত)। ফুসফুস পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রসারিত হতে পারেনা বলে শ্বাসকষ্ট হয়। গর্ভবতী নারীর গোড়ালি, হাত, পায়ের পাতা এবং মুখ ফুলে যায় তরল জমা হওয়ার কারণে। রক্ত সংবহন ধীর গতির হয়। মুখের ত্বকে কালো দাগ পড়তে পারে এবং পেট, উরু, ব্রেস্ট ও পেছনে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেয়।
(ভ্রূণের বৃদ্ধি)
গর্ভাবস্থায় সপ্তম মাসে গর্ভস্থ শিশু পদাঘাত করে এবং আলো ও শব্দের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়। সে চোখ খোলে ও বন্ধ করে। গর্ভস্থ শিশুর শরীরে অত্যাবশ্যকীয় খনিজ আয়রন ও ক্যালসিয়াম সংরক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ল্যানুগো পড়ে যাওয়া শুরু হয়।
আট মাসের সময় ভ্রুন খুব দ্রুতই ওজন লাভ করে। শরীরের হার শক্ত হতে থাকলেও মাথার খুলি নমনীয় থাকে প্রসব সহজ হওয়ার জন্য। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল গঠিত হয় এবং ভ্রুন হেঁচকি তুলতে পারে। শিশুর দেহের মোমের আবরণ বা ভারনিক্স মোটা হতে থাকে। গর্ভস্থ শিশুর শরীরে ফ্যাট বৃদ্ধি পায়। ফলে তার আকার বড় হতে থাকে এবং নড়াচড়া করার স্থান কমে যায়। নড়াচড়ার গতি কমে গেলেও মা নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন ঠিকই।
নবম মাসে ভ্রূণের আবাসস্থল প্রসারিত হয় এবং জন্মের জন্য ভ্রুনের মাথা শ্রোণি মাথা নীচের দিকে ঘুরে যায়। ফুসফুস তার কাজ পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায়। ভ্রূণের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। জন্মের সময় বাচ্চার ওজন ৬ পাউন্ড ২ আউন্স বা ৯ পাউন্ড ২ আউন্স থাকতে পারে এবং বাচ্চা ১৯-২১ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে।
এখন তো জেনে নিলেন গর্ভকালীন নয় মাসের পরিবর্তন। তবে এখানেই আপনার দায়িত্ব শেষ নয়। গর্ভাবস্থায় অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তার ফলোআপে থাকবেন। এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলবেন। সকল মায়েদের জন্য রইলো শুভকামনা।
পরবর্তী খবর আজকের হেলথ টিপস- অগ্নাশয়ের কাজ ও যত্ন