হৃদপিন্ডের যত্ন
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ১৬ই নভেম্বর ২০১৭, বৃহঃস্পতিবার
| দুপুর ০২:৩৩
মেডিকেল
মানুষের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোর মধ্যে হৃদপিন্ড অন্যতম। হৃদপিন্ড
বা হার্টের গ্রিক নাম কারডিয়া আর ল্যাটিন নাম কর। কর শব্দ থেকেই বলা হয় করোনারি। কোণাকৃতির মাংসল এই অঙ্গটি দুটো ফুসফুসের মধ্যে এবং বুকের ঠিক বাঁ পাশে অবস্থিত। বাঁ বগলের গোড়া থেকে প্রায় তিন বা চার ইঞ্চি দূরে হার্টের অবস্থান। যকৃতের বাঁ পাশের কিছু অংশ হার্টের নিচে রয়েছে। হার্টের দুই-তৃতীয়াংশ বাঁ আর এক-তৃতীয়াংশ ডান দিকে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের হার্টের ওজন ২৮০-৩৪০ গ্রাম আর নারীর ২৩০-২৮০ গ্রাম। হার্ট পেরিকার্ডিয়াম নামক দুটো অতি পাতলা আবরণে ঢাকা এবং চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। প্রকোষ্ঠগুলো যথাক্রমে ডান অলিন্দ, ডান নিলয়, বাঁ অলিন্দ, বাঁ নিলয়। হার্টে অজস্র ধমনি, শিরা-উপশিরা রয়েছে। এগুলোর সাহায্যে সারা দেহে রক্ত প্রবাহিত হয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত পাম্প করাই এই অঙ্গের কাজ। এ জন্য হার্টকে ‘ব্লাড পাম্পিং মেশিন’ বলে। হৃদপিন্ডে রক্ত ডান অলিন্দ থেকে ডান নিলয় এবং ডান নিলয় থেকে পালমোনারি নামক ধমনির সাহায্যে ফুসফুস, অতঃপর পালমোনারি শিরার সাহায্যে বাঁ অলিন্দ থেকে বাঁ নিলয়ে যায়। বাঁ নিলয় থেকে ধমনি, মহাধমনি, শিরার সাহায্যে ডান অলিন্দে পৌঁছায়। এভাবে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। হৃদপিন্ডে চারটি ভাল্ব বা কপাটিকা আছে। ধমনি, শিরা-উপশিরাবেষ্টিত রক্তবাহী মাংসল থলে দ্বারা ভাল্ব তৈরি। এরা দুই জোড়া করে যথাক্রমে ট্রাইকাসপিড বাইকাসপিক বা মাইট্রাল ভাল্ব নামে পরিচিত। ট্রাইকাসপিড হৃদপিন্ডের ডান আর বাইকাসপিড বাঁ দিকে অবস্থিত। প্রতি সেকেন্ডে ভাল্বগুলো খোলে আর বন্ধ হয়। ফলে হৃদস্পন্দনের জন্য ঢিব ঢিব শব্দ হয়, যা স্টেথিস্কোপ দ্বারা শোনা যায়। এই শব্দকে বলে ‘লাব ডাব’। প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে রক্ত সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, এভাবে হৃদপিন্ড প্রতি মিনিটে ৭০ থেকে ৮০ বার রক্ত পাম্প করে।
চারটি ভাল্ব রক্তের গতি এক দিকে রাখে এবং উল্টোদিকে যেতে বাধা দেয়। ফলে সারা দেহে রক্তের গতির সুনিশ্চিত সরবরাহ থাকে। মাতৃগর্ভ থেকে জন্মের আগেই একটি শিশুর হৃদপিন্ড তৈরি হয়। ভূমিষ্ঠ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে হৃদপিন্ডের কাজ। মৃত্যুর পরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাই হৃদস্পন্দন শোনা যায় না।
অবহেলা ও অযত্নের কারণে মানুষের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। রক্ত সরবরাহ বিঘ্নের জন্য শরীরে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন জটিলতা। কিছু অভ্যাস আমাদের দিতে পারে আরও কর্মময় হৃদপিন্ড। যেমন,
১। প্রতিদিন ১০-১২ গ্লাস পানি পান করুন। রক্তের ৮০ ভাগই পানি। নিয়মিত পানি পান রক্তের সঞ্চালন ঠিক রাখবে আর দেহের রোগজীবাণুকে মূত্রের সাহায্যে বাইরে বের করে দেবে। রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সঠিক থাকলে হার্ট সবল হবে।
২। আপনার গৃহে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য জানালা-দরজা খোলা রাখুন, প্রতিদিন ভোরে খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণ হাঁটুন। এতে আপনার রক্তে দূষণমুক্ত অক্সিজেনের মাত্রা বাড়বে। ফলে হৃদপিন্ডের বাঁ অলিন্দে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ার জন্য মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছাবে। ফলস্বরূপ মস্তিষ্ক ও হৃদপিন্ড অধিক কার্যকর হবে।
৩। অতিরিক্ত চর্বি, মসলা, মিষ্টিযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল, কাঁচা লবণ, জর্দা, গুল পরিহার করুন। ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মিষ্টিজাতীয় খাবার বর্জনীয়। এসব খাবার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হৃদপিন্ডের ছোট ছোট রক্তনালিতে চর্বি জমিয়ে দেয়। ফলে রক্তপ্রবাহে তীব্র বাধার সৃষ্টি হয়। তখন প্রয়োজন হয় হার্টের বাইপাস সার্জারির, যা বয়স্ক মানুষের জন্য ঝুকিপূর্ণ।
৪। যেকোনো বয়সের জন্যই ধূমপান বর্জনীয়। সিগারেটের নিকোটিন রক্তনালির সংকোচন করে হƒৎপিণ্ডে রক্তের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়, যা হার্টের জন্য ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।
৫। অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা, পারিবারিক কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন (স্বাভাবিক রক্তচাপ ১৩০ বাই ৯০)। প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন। দুশ্চিন্তা এড়াতে আপনার প্রিয় গল্পের বই পড়ুন, গান শুনুন, পছন্দের সিনেমা দেখুন বা প্রিয়জনের সঙ্গে বেড়াতে যান। সর্বদা হাসি খুশি থাকুন, পজেটিভ চিন্তা করুন। সম্ভব হলে উপাসনা বা মেডিটেশন করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করার সময় মস্তিষ্কের কোষগুলো বিশ্রাম পায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হার্ট সঠিকভাবে কাজ করে।
৬। মাত্রাতিরিক্ত যৌনবর্ধক ও গর্ভনিরোধক ওষুধ বর্জনীয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এসব ওষুধ খাবেন না। খেলোয়াড়, নৃত্যশিল্পী, ভারোত্তোলন কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা কাজ ছেড়ে দেওয়ার পরও আগের মতো কায়িক পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকুন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ধীরে ধীরে কাজের মাত্রা কমান। তা না হলে হঠাৎ করে অতি পরিশ্রমের পর শুধু বিশ্রাম নিলে হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জমে যাবে।
৭। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত খেলোয়াড় ও নৃত্যশিল্পীদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য হরমোনজাতীয় ওষুধ সেবন অনুচিত। যেকোনো কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে। বুকে ব্যথা মানেই হার্টের অসুখ নয়। ডায়াবেটিস ম্যালাইটাসে আক্রান্ত চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা নিয়মিত হার্টের চেকআপ করুন।
৮। অতিরিক্ত অলসতার কারণে কোলেস্টেরল, লিপিড জমে রক্তনালি ব্লক হয়ে যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী মনোভাব গড়ে তুলুন, মাত্রাতিরিক্ত ওজন কমান। প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি ও সুষম খাবার খান।
প্রিয় পাঠক, সুস্থ-সবল হৃদপিন্ডে আপনার জীবন হোক আরও কর্মময় ও সুন্দর।
ডাঃ ফারহানা মোবিন
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।
এম.পি.এইচ, সিসিডি (বারডেম হাসপাতাল)
সি-কার্ড (ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন)
কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট (কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন)
আগের খবর সুস্থ থাকুক আপনার হৃদয়
পরবর্তী খবর হাড়- মাংসপেশির অবলম্বন