এরপরে কে?
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৩০শে এপ্রিল ২০১৭, রবিবার
| বিকাল ০৩:৩৯
কলাম
গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি খবর দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশু মেয়েসহ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক বাবা। কারণ, দুই মাস যাবত মাত্র ৭ বছর বয়সী মেয়ের ধর্ষণের কোন বিচার পাননি ওই বাবা। বরং অভিযোগ করে তিনি নিজেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কোনো মীমাংসা ছাড়াই বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী মানুষেরা। ধর্ষণ বাড়ছে বাংলাদেশে৷ তার থেকেও বাড়ছে আসামীদের রেহাই পাওয়া।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ, কিশোরী তনুকে হত্যা করা হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়৷ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে চারবার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হলেও, তনু হত্যার সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক তো দুরের কথা, চিহ্নিত করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরং তদন্ত নিয়ে তনুর পরিবারকে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে৷ নানা ধরনের চাপের শিকার হচ্ছেন তাঁরা বলে জানিয়েছেন তনুর বাবা নিজেই।
রাজধানীসহ সারা দেশেই নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ আইন প্রয়োগ যেমন ঠিকমত হচ্ছে না তেমনি সামাজিকভাবেও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না৷ আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার হয় না অনেক মামলারই৷ কারণ শেষ পর্যন্ত নানা উপায়ে ভিকটিমকে দমিয়ে রাখা হয়৷ সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে দেয়া হয় না ৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় “ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট” নামে নতুন একটি আইন করার কথা বললেও তা এখনো কার্জকর হয়নি৷ আইন প্রয়োগে ঢিলেমি এবং সামাজিক অবস্থাই এখনকার এই অবস্থার জন্য দায়ী।
যেকোনো ধর্ষণের ঘটনায় আমরা ধর্ষকের বিচারের জন্য মিছিল শুরু করি, কিছুদিন হইচই করে থেমে যাই। কিন্তু এই ঘৃণ্য অপরাধের আসল অপরাধী কি শুধুই ধর্ষক নাকি সমাজও? রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, সব জায়গাতেই প্রতিনিয়ত নোংরামির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। কিন্তু তারা কিছু বলতে পারে না। কারণ মুখ খুললেই লোকে মন্দ বলবে, বিচার তো দূরে থাক আগে ঐ মেয়েকেই জবাবদিহি করতে হবে কেন সে এমনভাবে ছেলেদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে যে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়?
ধর্ষণ কেন হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে অনেকে অনেক ভাবে উত্তর দেন। কেউ বলেন ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, কেউ বলেন ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল, কেউ আবার সেই মেয়েটির চরিত্র আর পোশাক নিয়েই প্রশ্ন তুলে বসেন। কিন্তু শহরের চেয়ে গ্রামেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে। গ্রামে গঞ্জে যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কই ঠিক মত পাওয়া যায় না সেখানে গ্রামের মানুষ ইন্টারনেটের প্রভাবে খারাপ পথে যাবে এই যুক্তি মেনে নেয়ার মত নয়। আবার মেয়ের পোশাক আর চরিত্রই যদি ধর্ষণের মূল কারণ হয়ে থাকে তাহলে দিন দিন শিশু ধর্ষণের সংখ্যা এভাবে বাড়তো না।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে অত্যাচারীত হলে সে অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারে। তার প্রতিবাদের শক্তি এবং সাহস দুটোই থাকে। কিন্তু একটি শিশু বুঝতেই পারে না তার সাথে কি হচ্ছে। যে তাকে অত্যাচার করছে, যদি পরিচিত কেউ না হয় তাহলে পরবর্তিতে শিশুটি তাকে চিনতেও পারে না। যেসমস্ত শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের অর্ধেকেরই বয়স ১২ বছরের নিচে। অনেকের বয়স ৬ বছরও পেরোয়নি। এসব ঘটনার এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে কোনো মামলাও হয়না। শিশুটি যদি তার বাবা-মাকে সব খুলে বলে, তবুও প্রমাণের অভাবে মূল আসামীকে ধরা যায়না। আদালতে সেই শিশুটির স্বাক্ষীও একজন পূর্নবয়স্ক মানুষের মত গ্রহণ করা হয়না। ফলাফল, ধর্ষক নিরাপদ।
২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি নরসিংদীর একটি উপজেলায় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ৭ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করে। একজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় স্থানীয় থানার পুলিশ। আসামি এখনো জামিনে রয়েছে। খুঁজলে এরকম হাজার হাজার ঘটনা পাওয়া যাবে।
দিনাজপুরে গত বছরের ১৯ অক্টোবর ৫ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় আড়াই মাস পার হলেও এখনো কোন অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। ধর্ষণের শিকার শিশুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর না হলে বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটলে সাধারণত আইনি সহায়তা নেওয়া হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে ভিকটিমের পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়।
আবার ধর্ষণের পর খুনের ঘটনা ঘটে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই। কারণ, অপরাধী তার অন্যায়ের কোনো চিহ্ন রাখতে চায় না।
একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে গিয়েও তাকে অনেকবার অপমানের শিকার হতে হয়। প্রথমে পুলিশের কাছে তাকে তার ধর্ষণের বর্ণনা দিতে হয়।এই অবস্থায় মানসিক ভাবে আরোও ভেঙ্গে পরে সে। এরপর ডাক্তারী পরীক্ষা করতে গিয়ে আরেক লজ্জার সামনে পরতে হয় তাঁকে। মামলা চলাকালীন আসামী পক্ষের উকিল সবার সামনে মেয়েটির চরিত্রের দিকে আঙুল তোলে। সেই মেয়েকেই দুশ্চরিত্রা বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এরকম অবস্থায় উপযুক্ত রায় পান খুব কম মেয়েই। নিজের উপরে হওয়া অত্যাচার এর বিচার তো পেলেনেই না, উল্টা সমাজের চোখে বাকি জীবন দুশ্চরিত্রা হয়ে থাকতে হয় তাঁকে। এই অপমান, এই কষ্ট শুধু ঐ মেয়ে এবং তার পরিবার অনুভব করতে পারে। মানসিক ভাবে একটি মেয়ে ও তার পরিবার রোজ হাজারবার ধর্ষিত হচ্ছে সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে। এই অবস্থায় অনেক মেয়েই বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেক বাবা-মা ও এই নিষ্ঠুর পথে বা বাড়ায়।
এভাবে আর কতদিন মুখ বুজে থাকব আমরা? আজ ধর্ষিত হয়েছে আশমা, তার আগে তনু। এরপর কি আপনার বা আমার সন্তান? তার আগেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে।
পরবর্তী খবর কবে পূরণ হবে শ্রমিকের দাবী?