বউ-শাশুড়ি, মান-অভিমান, দোষ কার?


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৩১শে অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার  | বিকাল ০৩:২৮ দেশ

ই-বার্তা।। বিয়ের পর সব ঠিকঠাক থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ অস্বস্তিতে পড়েছে নতুন বউ। কারণ, শাশুড়ির কথাবার্তা ঠিক আপন শোনাচ্ছে না। কেমন যেন অভিমাণ জড়ানো গলায় কথা বলেন বৌমার সাথে। সব কিছুতেই খুঁত ধরা, খুঁজে খুঁজে দোষ বের করা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। স্বামীর সাথে বাইরে বেড়াতে গেলেও কথা শুনিয়ে দিচ্ছে শাশুড়ি। নতুন সংসারে শাশুড়ির এমন ব্যবহারে মন ভেঙ্গে যায় নতুন বউয়ের। কিন্তু শাশুড়ি কেন এমন আচরণ করছে বা এই জাতীয় অভিযোগ আমাদের দেশের প্রায় সকল বউ ও শাশুড়ি কেন করছে সেই কারণ গুলো কি আমরা খুঁটিয়ে দেখেছি কখনো?

আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখতে পাই শাশুড়ি-বউয়ের খারাপ সম্পর্ক। কেন এমন পরিস্থিতি হয় তা ভাবার আগেই সংসারে মাত্র পা রাখা মানুষটিকে দোষারোপ করে বসি আমরা। বিষয়গুলোকে ধামা চাপা দিয়ে রাখতে রাখতেই সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় নতুন বউটি। এমনকি নিজেকে সেই সংসারের একজন বলে ভাবতেও কষ্ট হয় তার। ফলে মানিয়ে নেয়া অসম্ভব মনে হয় তার, অথবা মানিয়ে নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনা সে, আর অশান্তি বেড়ে যায় সংসারে।

তিক্ত হলেও সত্যি যে, অধিকাংশ শাশুড়িই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ছেলের বউকে ঈর্ষা করে থাকেন। এদিকে এই কথাও সত্যি যে বিয়ের পর মেয়েরাও তার স্বামীকে নিজের একচেটিয়া অধিকার ভাবা শুরু করে। আসুন জেনে নেয়া যাক ছেলের বউ ও শাশুড়ির দ্বন্দের কয়েকটি মূল কারণ ও বিশ্লেষণ।

১। ছেলের জীবনে দখলদারিত্ব
বেশিরভাগ ছেলেরা নিজেদের ব্যপারে সবসময়ই উদাসীন। জম্নের পর থেকেই একটি ছেলের সময়মত খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য অভ্যাসগুলো তার মা দেখাশুনা করে থাকে। বিয়ে করানোর আগ মূহূর্ত পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক ভাবে ছেলের জীবনের পুরো দখলটা নিজের কাছে থাকে। কিন্তু বিয়ের পরেই সেই দখলদারিত্ব অনেকাংশেই ছেলের বউয়ের কাছে চলে যায়। ইচ্ছে বিরুদ্ধে এই দখলদারিত্বের হাত বদল অনেক শাশুড়িই মেনে নিতে পারে না।
আবার একটি মেয়েও যখন একজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করে, তখন সেও চায় নিজ দায়িত্বে তার স্বামীর সব কাজ করে দিতে। যেমন, খাবার দেয়া, অফিসে যাওয়ার পোশাকটা আয়রন করে দেয়া, কোন অনুষ্ঠানে কি পোশাক পরবে এইটা ঠিক করে দেয়া। প্রথমে ভালোবাসা ও পরে সেটি অধিকার আর সেইসাথে দায়িত্ববোধে পরিণত হয়। ফলে একজন স্ত্রীও চাইবেনা তার স্বামীর জীবনে অন্য কেউ দখলদারি করুক। হোক সে তাঁর শাশুড়ি।

২। সংসারের ভাগ দেয়া।
ছেলের বিয়ের আগ পর্যন্ত পুরো সংসারটা শাশুড়ির কর্তৃত্বে থাকে। কিন্তু ছেলের বিয়ের পরে ঘর, বাড়ি, রান্নাঘর, সংসারের খরচ, নিয়মকানুন অনেক কিছুই ছেলের বউয়ের অধীনে চলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই। একটি বউয়ের চোখে এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ এই পরিবর্তন অনেক শাশুড়িই মেনে নিতে পারেন না এবং তাঁর মনের গভীরে অভিমানের সৃষ্টি হয়। আর এই অভিমানের ফলেই ছেলের বউকে ঈর্ষা করেন তারা। এর প্রভাব ছেলে, ছেলের বউ দুজনের উপরেই গিয়ে পড়ে। ফলে একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয় সবাইকে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে বউ-শাশুড়ি দুইজনকেই একটু বুঝে শুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন,
শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে তিনি নিজেও একদিন বউ হয়ে এই সংসারে পা রেখেছিলেন। আজ হোক, কাল হোক একইভাবে তার ছেলের বউকেও তাঁর মতই সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই নিজে থেকেই বউকে কিছু কিছু দায়িত্ব দিয়ে দিতে হবে। ভূলে গেলে চলবে না ছেলের বউও এখন এই পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই গুরুত্বটা তাঁকে বুঝিয়ে দিলেই দেখবেন নতুন বউও খুব দ্রুত আপন করে নিবে পরিবারটিকে। আর শাশুড়ি যখন নিজে


থেকেই বউকে সংসারের দায়িত্ব দিবেন, তখন সেই বউয়ের কাছে সব থেকে সম্মানের ও ভালোলাগার জায়গায় থাকবেন তার শাশুড়ি।
অন্যদিকে নতুন বউকেও মাথায় রাখতে হবে। এত বছর যে মানুষটি একটি সংসার সামলে চলেছেন, তার জন্য সংসারের ভাগ অন্য একজনকে সঁপে দেয়া খুব একটা সহজ নয়। একবারে পুরো সংসার বউয়ের হাতে চলে আসবে এটা আশা করা যেমনি অযৌক্তিক, তেমনি ভূল। বরং তার উচিত শাশুড়িকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে বুঝিয়ে দেয়া যে সংসারের দায়িত্ব নিতে বউ সর্বদা প্রস্তুত। গতানুগতিক রান্নার বাইরে অন্য কিছু রান্না করতে চাইলে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে নেয়া, ঘরের কোন আসবাব বদলাতে বা নতুন আসবাব কিনতে চাইলে শাশুড়িকে সাথে নিয়ে কিনতে যাওয়া, এধরণের কাজ করলে শাশুড়ি তাঁর ছেলের বউয়ের পছন্দে আপত্তি তো করবেই না বরং খুশিই হবে। তিনি নিজেও নিজের কাছে গুরুত্ব হারাবেন না। আর ছেলের বউ সংসার নিয়ে ভাবছে, এই বিষয়টিও তাঁকে খুশি করবে।

৩। ছেলের জীবনে গুরুত্ব কমে যাওয়া।
ছোটবেলা থেকে ছেলেকে বড় করা পর্যন্ত ছেলের জীবনের সবকিছু জুড়ে থাকেন মা। কিন্তু বিয়ের পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেরা স্ত্রীকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তখনই মায়ের মনে শঙ্কা উঁকি দেয়, ছেলে তার বউ কে মায়ের থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যা আসলে অহেতুক। একজন মাকে এই কথা মাথায় রাখতে হবে যে, যাকে তাঁর ছেলে বিয়ে করে জীবনসঙ্গিনী করেছে, সেই মেয়েটিও তাঁর ছেলের জীবনে কম গুরুত্বের কেউ নয়। তাঁর ছেলের জীবনের সাথে এখন জড়িয়ে গেছে ছেলের বউয়ের জীবনটিও। আর একটি ছেলের কাছে তার মায়ের এবং স্ত্রীর জায়গা সবসময়ই আলাদা। এক্ষেত্রে কেউ কারো জায়গা দখল করা অসম্ভব। তাই বউ-শাশুড়ির মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে খোঁচাখুঁচি হওয়া অবান্তর।

৪। প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব।
কিছু কিছু শাশুড়ির অভ্যাস, সবসময় নিজের সাথে ছেলের বউকে তুলনা করা। সেইসব শাশুড়িরা সবসময়েই ছেলের বউয়ের সামনে বলতে থাকেন যে, তিনি তার ছেলের বউয়ের চাইতে অনেক কম বয়সে বউ হয়ে এসেছিলেন, অনেক কাজ এক হাতে সামলাতেন, শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের উপর কথা বলতে পারতেন না, তাঁদের সেবা যত্ন করতেন, বাপের বাড়ি যেতে পারতেন না ইত্যাদি। এগুলো শুনলে ছেলের বউ হীনমন্যতায় ভোগে এবং সামনের দিনের কথা চিন্তা করে ভয়ও পায়। আর তখনই তার শাশুড়িকে একজন দূরের মানুষ মনে হয়। সে নিজেকে অনেক গুটিয়ে নেয়। শাশুড়িকে বুঝতে হবে যে, একজন নতুন মানুষ কয়েকদিনেই একটি নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতেও পারবেনা আর সব নিয়মকানুনও শিখে যাবে না। এক্ষেত্রে শাশুড়িদের যা করা উচিত তা হোলো ছেলের বউয়ের কাজের প্রশংশা করা। নিজেকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে বউকে সাহায্য করা। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে সে এখন এই পরিবারেরই একজন সদস্য।
আবার একজন নতুন বউয়েরও উচিত শ্বশুর বাড়িকে শ্বশুর বাড়ি না ভেবে নিজের বাড়ি মনে করা। কথায় কথায় বাপের বাড়িতে সে কিভাবে বড় হয়েছে, কিভাবে দিন কাটিয়েছে, কি খেয়েছে, কাজ করেছে নাকি আরাম করেছে এগুলো একেবারেই না বলা। কারণ প্রতিটি বাড়ি একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। তাঁর একার পছন্দে একটি বাড়ির সব নিয়ম বদলে যাবে না। এই সত্যিকে মেনে নিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে আর একটু একটু করে নিজের নতুন বাড়ির নিয়ম কানুন শিখে নিতে হবে।

একটি পরিবেশ কখনো একা একজন মানুষ বদলে দিতে পারেনা। তাই আমাদের সমাজে বউ-শাশুড়ির এই দ্বন্দ কাটাতে চাইলে এগিয়ে আসতে হবে দুই পক্ষকেই।

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ এর আরও সংবাদ