বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৯ই মে ২০১৭, মঙ্গলবার
| দুপুর ১২:২২
১
আমাদের প্রতিবেশী রাস্ট্র ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে ‘পর্যটন শিল্প’ হিসাবে দেখা হলেও কেন যেন আমাদের স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে পারিনি। অথচ এই দেশটার অনেক প্রাচীন স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েও দিন দিন শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের একটা নগর সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। আমাদের সংবাদ মাধ্যম সেদিকে নজর দিলে হয়তো আজ শুধু দেশের স্থানীয় মানুষ নয় বরং পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে পর্যটকরা এদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য দেখার জন্য ছুটে আসতে পারতো!
আড়াই হাজার বছর আগের উয়ারী-বটেশ্বর কিংবা দুই হাজার তিনশো বছর আগের মহাস্থানগড় ছাড়াও ইউনেস্কো স্বীকৃত আমাদের দুইটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা’ তথা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এবং বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদ আছে। এছাড়াও এদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকশ প্রত্নস্থল। কিছুদিন আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা মুন্সিগঞ্জে বিক্রমপুর বিহার আবিস্কার করেছে। বিক্রমপুরের বজ্রজোগিনী গ্রামে জন্ম নেয়া শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানের পাশেই আবিষ্কৃত এই বিহারটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও এখন পর্যন্ত অনেক প্রত্নস্থল অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অনেক মানুষ এখন বিদেশের প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক স্থান দেখতে যায়। অথচ আমাদের নিজেদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকশো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল। আমরা কেন পারছিনা সেগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে? যেখানে বর্তমান পৃথিবীতে প্রত্নস্থল একটা বিশেষ ‘পর্যটন শিল্প’ হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে সেখানে আমাদের দুইটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা’ এবং এতোগুলো প্রত্নস্থল থাকার পরেও সেগুলো আমাদের নিজেদের কাছেই এখনও অবহেলিত!
ইউনেস্কো কোন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলকে স্বীকৃতি দিলে সেটি আঞ্চলিকতার গন্ডি পেরিয়ে হয়ে পড়ে বৈশ্বিক সম্পদ। আমাদের দুইটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা থাকার পরেও সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি। ইদানীংকালে পৃথিবীর অনেক দেশেই ‘পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরেক্ষণ’ নামক বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠদান করা হলেও আমাদের দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয় নিয়ে পাঠদান করার প্রচলন এখন পর্যন্ত ঘটেনি বরং ‘পর্যটন এবং হোটেল ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার ফলে ‘পর্যটন এবং হোটেল ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি শুধুমাত্র ‘বিশেষ স্থানে চাকুরী নির্ভর’ প্রত্যয় হিসাবে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে যথাযথ সংরক্ষণ এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক স্থাপন করার দায়িত্ব নিবে কারা?
‘বিশেষ স্থানে চাকুরী নির্ভর’ প্রত্যয়টির দিকে নজর না দিয়ে যদি দেশের প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘পর্যটন এবং হোটেল ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ের পাশাপাশি ‘পর্যটন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরেক্ষণ’ নামক বিষয়ে পাঠদান করা হয় তাহলেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবন শেষে এদেশে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিতভাবেই পাবে। কারন এই সেক্টরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল সংরক্ষণ এবং পুনরানয়নের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন। পাশাপাশি দক্ষ ‘পর্যটক গাইড’ নামক ধারণাটির যথাযথ প্রয়োগ করার যথেষ্ট সুযোগ আমাদের রয়েছে। ভারতের পর্যটন শিল্পে সেদেশের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ জড়িত। বিদেশী পর্যটক এলে তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প কিছুই হতে পারেনা। আমরা এক্ষেত্রে ‘নালন্দা বিহার’ এর উদাহরণ দিতে পারি যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে দাবী করা হচ্ছে। ভারত সরকার প্রায় ১৫০০ বছর আগের প্রতিষ্ঠিত এই বিহারটিকে আবার নতুন করে ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ নাম দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে যেন স্থানীয় এবং বিদেশী পর্যটকরা জানতে পারে যে সেদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ স্থানগুলোতে ভারতের শিক্ষিত এবং দক্ষ শিক্ষার্থীরা পর্যটকদের গাইড হিসাবে কাজ করে। সেখানে পর্যটন এবং ঐতিহ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সেই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করা শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। যার ফলে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে তারা যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং একইসঙ্গে পর্যটকদের সামনে খুব দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে পর্যটন শিল্প ভারতের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস হিসাবে বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছে।
নালন্দা বিহার পৃথিবীর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃতি পেলে আমাদের পাহাড়পুর বিহার হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ভারত যদি তাদের প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে নতুন করে জনসম্মুখে তুলে ধরতে পারে তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো? কেন পাহাড়পুরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানানোর জন্য সেখানে কোন দক্ষ পর্যটক গাইড থাকবেনা? কেন সেখানে প্রতিবছর বৃষ্টির পানি জমে? ইউনেস্কো ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা’ সংরক্ষণের জন্য যে গাইডলাইন প্রণয়ন করে সেটার বাস্তবায়ন আমরা করতে পারিনা কেন?
পৃথিবীর প্রায় সব দেশের পাবলিক পরিবহন বিশেষ করে উড়োজাহাজের কথা যদি বলি সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু স্যুভেনির থাকে সেই দেশের পর্যটন শিল্পের উপর ভিত্তি করে যেন ভ্রমণকারী খুব সহজে সেই নির্দিষ্ট দেশের পর্যটন শিল্প সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। আমাদের দেশের ‘বাংলাদেশ বিমান’ কি সেসব কখনো প্রচার করার চেষ্টা করেছে? আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে যতোগুলো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আছে সেগুলোর কোনটিই আমাদের ‘সাংস্কৃতিক পর্যটন’ নিয়ে কখনোই আকর্ষণীয় কোন প্রচারণা চালায় না। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাংস্কৃতিক পর্যটন শিল্পে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ। পাহাড়পুর কিংবা বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদের আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছে এগুলোর কোন মুল্য সেই সময় পর্যন্ত থাকবেনা যতদিন পর্যন্ত তাদেরকে এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত করা হবেনা। আমাদের দেশের অনেক গ্রামে মানুষ হস্তশিল্প বানাতে পারদর্শী। যারা ভাল হস্তশিল্প বানাতে পারে তাদেরকে প্রত্নস্থলের পাশেই তাদের নিজস্ব উৎপাদন বিক্রয় করা সুযোগ দিলে একদিকে তাদের উপার্জন হতো অন্যদিকে তারা নিজেরাই নিজের প্রয়োজনে ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণ করতে উদ্বুদ্ধ হতো। আমরা চাই আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো টিকে থাক আরও হাজার বছর। একই সঙ্গে ‘পর্যটন শিল্প’ হিসাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
লেখকঃ
মোঃ রিফাত-উর-রহমান
সিনিয়র লেকচারার
বাংলাদেশ স্টাডিজ
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
পরবর্তী খবর ভালো থেকো বিপ্লবী চে !