সাদা মনের মানুষ সুব্রত ভট্টাচার্য- ষষ্ঠ পর্ব
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ৩১শে মে ২০১৭, বুধবার
| দুপুর ০১:৩৫
দেশ
(ছবিতে সুব্রত ভট্টাচার্যের স্ত্রী স্বাগতা ভট্টাচার্য)
যে আলো কখনো নেভেনা, যে আলো মার্তন্ডের প্রায়, যে আলোর স্পর্ধা নক্ষত্রের মতো, যে আলোয় স্নান করে জ্ঞান সঞ্চয় হয়, যে আলো শুভ্র আকাশের মতো উদার, যে আলো স্থির, যে আলো সত্যিই যেন ধ্রুব, যে আলো জন্মের পর থেকেই নিয়েছে শুধু ভালোবাসার ব্রত, সেই ব্রতের নাম সু-ব্রত (সুন্দর ধ্যান বা তপস্যা)। তিনি সেই আলোয় উদ্ভাসিত ব্যক্তি যিনি আপন মহিমায় আলোকিত। যাঁর নাম বাবা-মা অনেক আদর করে রেখেছেন সুব্রত ভট্টাচার্য।
আমি সেই সুব্রত ভট্টাচার্যের জীবনাতিহাস নিয়ে লিখছি গত প্রায় একমাস ধরে। একজন মানুষের জীবদ্দশায় জীবনাতিহাস লেখা অনেকটা কঠিন। কিন্তু কী করবো পাঠক, বলুন? আমাকে যে সবকিছু তুলে ধরতেই হবে।
ভালোবাসা। চার অক্ষরের একটি শক্তিশালী নাম। যে নামের ক্ষমতায় গোটা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা সম্ভব। ভালোবাসাই পারবে বিশ্ববাসীকে এক করতে কিন্তু বিশ্ববাসী ভালোবাসার সেই মূল্য কোনোদিনও দিতে পারবেনা। ভালোবাসা নীরবে একাকী গুমরে গুমরে কাঁদে। কাঁদুক। তাতে সুব্রত ভট্টাচার্যের কিছু আসে যায় না। কারণ তিনি ভালোবাসাকে জয় করতে পেরেছেন। পাঠক অবশ্য এখানে প্রশ্ন করতে পারেন, কোন সে ভালোবাসা? কোন সে প্রেম? এ প্রেম মানবপ্রেম, বিশ্বপ্রেম। আর এজন্যই সুব্রত ভট্টাচার্য অহংকার করে বলেন, “আমার জীবনটা যেন ভালোবাসার জীবন। বিশ্বপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটা ক্ষুদ্র জীবন। তাই আমার কোনো কষ্ট নেই। কোনো দুঃখ আমাকে আহত করতে পারেনা”।
দুঃখ, কষ্ট এসব শব্দের সাথে আপনার পরিচয় আছে পাঠক? তবে শুনুন সুব্রত ভট্টাচার্যের জীবন পরিক্রমা। যে পরিক্রমায় বাস করেও একজন মানুষ কীভাবে বলতে পারেন, “আমার কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই”।
এবারে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সরাসরি প্রবেশ করতে চাই। তিনি বিয়ে করেছেন ১৯৮২ সালে। বিয়ের পর বিধাতা তাঁকে একটি বড় পুরষ্কারে পুরস্কৃত করেছেন। যে পুরষ্কারের নাম উৎসা। কেউ বলেন বিপাশা। আর সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন তানিমনি। এই তানিমনি নামক পুরষ্কারটিই হচ্ছে তাঁর একমাত্র মেয়ে, একমাত্র সন্তান। খুব ভালো কাটছিলো সুব্রত ভট্টাচার্যের দাম্পত্য জীবন। যে জীবনে ছিলনা কোনো ক্লেদ, ছিলনা যন্ত্রণা, ছিলনা পিছুটান, ছিলনা হতাশার কোনো হাতছানি। স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে সুব্রত ভট্টাচার্য যেন স্বর্গেই বসবাস করছেন। কিন্তু তাঁর এই স্বর্গীয় সুখের জীবনে হঠাৎ একটা ঝড় এসে এলোমেলো করে দিল সবকিছু। একটা অশুভ থাবায় দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দিল সুখ নামক সুখের বাগান।
সুদুর রাজশাহী থেকে আনন্দ পালকীতে সুব্রত ভট্টাচার্য যে রাজকন্যাকে জীবনসাথী করে চৌবাড়ীর বধু করেছেন, তাঁর নাম স্বাগতা ভট্টাচার্য। যিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা জীবনানন্দের সেই নাটোরের বনলতা সেনের মতোই। যার চুল ছিল যেন বিদিশার নিশা। মুখ শ্রাবস্তীর কারুকার্য। পাখির নীড়ের মতো কালো দুটি চোখ। আর হাসি? হাসি ছিল নীল নীলিমায় ভেসে বেড়ানো, গোধুলীর চিলের মতো ক্ষণস্থায়ী। এখানে ক্ষণস্থায়ী শব্দটা এজন্য লিখলাম যে, দীর্ঘ জীবনের সামান্য সময় ছিল তাঁর কাছে এই পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করার জন্য। এ যেন বিধাতার অদৃশ্য হাতের দৃশ্যমান পাশা খেলা।
১৯৯২ সালে অমর সঙ্গী স্বাগতা ভট্টাচার্য যখন দুরারোগ্য ব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তখন সুব্রত ভট্টাচার্যের হাসি, আনন্দ, সুখ ও স্বপ্ন যেন ঘূর্ণায়মান বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল তলে ঝিনুকের পাশে গুটি সুটি হয়ে লুকিয়েছিল। যাকে খুঁজে পাবার সাধ্য পৃথিবীর কোনো ডুবুরিরতো দুরের কথা সমুদ্র বিজ্ঞানিরও নেই। সাধকদের চোখের জল কখনো মাটিতে পড়েনা, পড়ে সাগরের মাঝখানে। এজন্য হয়তো তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর এত বড় একটা রোগের কথা জেনেও সুব্রত ভট্টাচার্য কখনো লোকসম্মুখে কাঁদেননি। তবে স্ত্রীকে সুস্থ করে তোলার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। স্ত্রীর জন্য টানা তিনটি বছর স্কুল, গান সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্ত্রীর প্রতি সুব্রত ভট্টাচার্যের এ মমতা যেন শিরি ফরহাদকেও হার মানায়। কিন্তু নিয়তি নামক ভেলকিবাজির নেই কোনো মায়া, নেই কোনো মমতা। মমতা থাকলে সে সুব্রত ভট্টাচার্যের ১০ বছরের ফুটফুটে মেয়ে উৎসার কথা ভাবতো , ভাবতো সুব্রত ভট্টাচার্যের হৃদয় আহাজারির মর্মস্পর্শি ব্যাথা। যে ব্যাথার মুখ আছে কিন্তু কথা নেই, অস্থিরতা আছে কিন্তু সাড়াশব্দ নেই । সবাই জানে স্বাগতা ভট্টাচার্য না ফেরার দেশে যাওয়ার জন্য ভিসা-পাসপোর্ট করেছেন। এখন শুধু রথে উঠা বাকি। হয়তো এজন্যই মৃত্যুর আগের রাতে পরম প্রিয় সুব্রত ভট্টাচার্যকে কাছে ডেকে স্বাগতা বলেছিলেন, “সুব্রত, আমি বুঝি বেশিক্ষণ নেই। এই পৃথিবীতে যত নারী আছে তাদের মধ্যে আমিই সবথেকে দূর্ভাগা, অভাগিনী। যে তোমার মতো একজন মহৎপ্রাণ স্বামী পেয়েও একসাথে সারাটাজীবন সংসার করতে পারলাম না। আমিতো তোমার মতো বড় কোনো শিল্পী নই, জ্ঞানী নই যে গুছিয়ে কথা বলবো। তবু তোমার কাছে আজ আমার একটা মিনতি। মেয়েটাকে দেখে রেখ। ওকে কোনোদিন কারো কাছে দিওনা। তোমার বুকের মাঝখানে ওকে আগলে রেখ”। একথা যখন হচ্ছিল তখন সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "স্বাগতা, তুমি ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার তোমাকে কথা বলতে বারণ করেছেন। কিন্তু স্বাগতা স্থির থাকতে পারছিলেন না। তাঁর যে অনেক কথা বলার আছে। বারণকে উপেক্ষা করে চোখ ফেটে আসা জল মুছতে মুছতে স্বাগতা বলতে থাকেন, "সুব্রত, তোমার কাছে আমার আর একটা শেষ মিনতি আছে। কথা দাও রাখবে?" সুব্রত ভট্টাচার্য বললেন, "বলো। আজ তোমার সব কথা রাখবো”। অশ্রুভরা কণ্ঠে স্বাগতা বললেন, “আমি তোমাকেও অন্য কারো হাতে তুলে দিতে পারবোনা। তোমাকে আমি সাথী করে নিয়ে যেতে চাই। তুমি যাবে আমার সাথে”? এই শেষ কথাটুকু বলে বালিসের মধ্যে মুখ রেখে ডুকরে কাঁদছেন স্বাগতা ভট্টাচার্য। যে কান্না ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আর সুব্রত ভট্টাচার্যের কর্ণাবদ্ধ। সুব্রত ভট্টাচার্য আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ ঢেকে ফেললেন তিনি।
রেজাউল করিম রেজা
(লেখাটি চলবে, চোখ রাখুন)
আগের খবর রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস
পরবর্তী খবর সাদা মনের মানুষ সুব্রত ভট্টাচার্য- সপ্তম পর্ব