সাদা মনের মানুষ সুব্রত ভট্টাচার্য- সপ্তম পর্ব


ই-বার্তা প্রকাশিত: ৫ই জুন ২০১৭, সোমবার  | দুপুর ১২:৪২ দেশ

ছবিতে সুব্রত ভট্টাচার্য, স্বাগতা ভট্টাচার্য এবং তাঁদের একমাত্র মেয়ে বিপাশা ভট্টাচার্য (উৎসা)।

সুব্রত ভট্টাচার্য আর কোনো বিলম্ব না করে বললেন, “আজ তোমার কোনো কথাই আমি অপূর্ণ রাখবোনা কাবেরী (স্বাগতা ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত নাম)। তোমার যা ইচ্ছে বলো। আমি সুব্রত বলছি, জীবনে কারুর কাছে আমি কোনোদিন মাথা নত করিনি। কথা দিয়ে কথা না রাখার কাজটা আমার না। তবে একটি বিষয় আমার কাছে খটকা লেগেছে। তুমি আমার কাছে প্রশ্ন করেছো, তুমি যাবে আমার সাথে? এর মানেটা একটু বলবে কি”? স্বাগতা ভট্টাচার্য আবারো নড়েচড়ে উঠে বসে বললেন, “জানি সুব্রত। তুমি কিছুতেই আমাকে ছাড়তে চাচ্ছোনা। কিন্তু আমাকে যে যেতে হবেই। আমি যেন থেকেও নেই, না থেকেও আছি। তোমাকে আর উৎসাকে ছেড়ে যেতে আমার কি কম কষ্ট হচ্ছে? আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তবু......” স্বাগতা ভট্টাচার্যের কথা শেষ হতে না হতেই সুব্রত ভট্টাচার্য যেমনি তার মুখটি হাত দিয়ে বন্ধ করলেন, অমনি স্বাগতা ভট্টাচার্য সুব্রত ভট্টাচার্যের হাত শক্ত করে ধরে ফেললেন। অনেক শক্ত করে। কিন্তু কেন? কি বলতে চান স্বাগতা ভট্টাচার্য? কি এমন কথা যা এতদিন তিনি বলেন নি? কি কথা যা সুব্রত ভট্টাচার্যের হাত শক্ত করে ধরে বলতে হবে? কিসের এত জোর স্বাগতা ভট্টাচার্যের? এ জোর যে প্রকৃত ভালোবাসার জোর। ভালোবাসার জোর বলেইতো অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে স্বাগতা ভট্টাচার্য বললেন, “সুব্রত, আমি তোমাকে কারুর কাছে দিয়ে যেতে পারবোনা। তোমার পবিত্র ও মহৎ হাতে যে সাধারণ হাতটি আমি রেখেছি সে হাতে অন্য কোনো সাধারণ কিংবা অসাধারণ, সামান্যা কিংবা অসামান্যা নারীর হাত স্পর্শ করুক আমি চাইনা। তাই, আমি তোমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। কারুর কাছে তোমাকে দিয়ে গেলাম না। জন্মের পূর্বেও তুমি আমার ছিলে, আছো এবং মৃত্যুর পরেও তুমি আমারই থাকবে”। এ কথা বলে স্বাগতা ভট্টাচার্য ধীরে ধীরে সুব্রত ভট্টাচার্যের মুষ্টিবদ্ধ হাতটি ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

সেই কথা বলাই ছিল তার শেষ কথা বলা, সেই হাত ধরাই ছিল তার শেষ হাত ধরা আর সেই শোওয়াই যে ছিল তাঁর শেষ শোওয়া তা সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো জ্ঞানী, শিল্পী, সাধকের পক্ষে বোঝা খুবই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। স্তব্ধ, নির্বাক এবং নিথর সুব্রত ভট্টাচার্য বুঝতেই পারছেন না একি বিশ্রামের নিদ্রা নাকি চির নিদ্রায় শায়িত হলেন স্বাগতা ভট্টাচার্য? সুব্রত ভট্টাচার্যের ভাবুক মনটা অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই পায়চারি শুরু করলো। এ পায়চারি যেন বিমর্ষ কোনো রোগীকে হাসপাতালের ওটিতে অপারেশন চলাকালীন অবস্থায় বারান্দায় স্বজনদের চরম দুশ্চিন্তার মতোই। কি করবেন সুব্রত ভট্টাচার্য? প্রিয়তমা স্ত্রীকে কি ডাকবেন? নাহ্ । এ যেন প্রবল ঝড়ে আটকে যাওয়া নীড় হারা পাখির মতোই হয়ে যাচ্ছেন সুব্রত ভট্টাচার্য। কখনো স্বাগতা ভট্টাচার্যের পাশে গিয়ে বসছেন আবার কখনো বা স্নেহের পরশ মাখানো হাতটি তাঁর মাথায় আলতোভাবে বুলিয়ে দিচ্ছেন। শুধু একবার স্বাগত ভট্টাচার্যের কানের কাছে ফিসফিস করে সুব্রত ভট্টাচার্য তার নাম ধরে আদর করে ডেকেছেন, “কাবেরী”।

হায়রে কাবেরী, হায়রে স্বাগতা ভট্টাচার্য, হায়রে সুব্রত ভট্টাচার্যের অমর সঙ্গী অভাগিনী প্রিয়া। অবশেষে, ১০-১২ বছরের ফুটফুটে সোনার টুকরা মেয়ে উৎসা ভট্টাচার্যকে মা হারা আর সুব্রত ভট্টাচার্যকে স্ত্রী হারা করে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে ১৯৯৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর চলে গেলেন তিনি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন কিছুক্ষণের জন্য সুব্রত ভট্টাচার্যের বাকরুদ্ধ অবস্থাই প্রমাণ করে স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসাটা ছিল কতটা তীব্র। পালকীতে নিয়ে আসা রাজশাহীর রাজকন্যাকে যখন বাবার বাড়িতে লাশ হিসেবে নেয়া হলো তখন একমাত্র নয়নের মণি উৎসার আহাজারি আর গগনবিদারী কান্না রাজশাহীর আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছিল।

পাঠক, মা হারা সন্তানের কান্না কখনো কি শুনেছেন আপনি? কিংবা আপনি কি মা হারা হয়েছেন? যদি মা হারা সন্তানের কান্না আপনি শুনে থাকেন কিংবা নিজেও মা হারা হয়ে থাকেন তবে উৎসার করুন কান্না উপলব্ধি করতে পারবেন। উৎসাকে সকলে স্নেহের পরশ দিয়ে টানলেও সেদিন বাবার কোলেই সে লাফিয়ে পড়েছিল এবং বাবাকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। কারণ, বাবাও যদি ওরকম করে হারিয়ে যায় তার কাছ থেকে। সেই থেকে উৎসা বাবার মাঝেই মাকে খুঁজে পেয়েছে আর গর্বিত বাবা সুব্রত ভট্টাচার্যও তাঁর হৃদয়ের সমস্থ স্নেহ দিয়ে উৎসাকে বড় করে তুলেছেন।

রেজাউল করিম রেজা
(লেখাটি চলবে, চোখ রাখুন)

সর্বশেষ সংবাদ

দেশ এর আরও সংবাদ