বোধ- পুনম মায়মুনী
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার
| দুপুর ১২:৪৩
প্রতিক্রিয়া
মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বোধশক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যতই ভাল চরিত্রের অধিকারী হউক না কেন, কোন কাজের ভাল কি মন্দ কিংবা তার পরিনতি কি হতে পারে, যদি সেই অনুভূতি বা বোধশক্তিই না থাকলো তবে সে একটি জড় পদার্থের মতোই।
আমি অনেক উচ্চশিক্ষিত, বিবেকবান মানুষদেরও দেখেছি যারা অন্যের অধিকার খর্ব করা, ব্যাক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করা, অশোভনীয় প্রশ্ন করা এ ধরণের কাজ করছে যেগুলো দৃষ্টিকটু। এটা যে সে, অন্যের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানছে, অসম্মান করছে সেই বোধটুকুই তার মধ্যে নেই। এই বোধহীন মানুষগুলোই বিবেকহীনের মতো অসামাজিক ও অমানবিক কাজগুলো করে থাকে।
এক পরিচিতার বাসায় দেখেছিলাম, বিকেল প্রায় চারটার কাছাকাছি, ১২/১৩ বছরের একটি মেয়ে কাজ করে ঐ বাসায়। তখনো পর্যন্ত মেয়েটি দুপুরের খাবার খায়নি, মুখটি চুপসে গেছে। পরে জানতে পারলাম, ওদের (কাজের মেয়েদের) পেট ভরা থাকলে নাকি আলসেমি এসে যায়, ভাল করে কাজ করেনা। তাই সব কাজ শেষ করে তারপর খাবে। রোজই এক নিয়ম। অথচ তাঁর নিজের বাচ্চাটি সকালের নাস্তা, স্কুলে টিফিন, দুপুরের খাবার খেল এখন বিকেলের নাস্তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই যে মানুষের প্রতি মায়া-মমতাহীন, বিবেকহীন, নিষ্ঠুরতার আচরণ, এগুলো আপনি, আমি কাউকে জোর করে বা আইনের আওতায় এনে বিচার করার ব্যাপার নয়। শুধুই বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের বিবেকবোধ জাগানোটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অন্যের কষ্ট তার ভিতর কোন অনুভূতির সৃষ্টি করেনি ফলে এটাই তার কাছে স্বাভাবিক। অনেক অভিভাবকদের গর্ব করে বলতে শুনেছি- “আমার সন্তানের কোন ইচ্ছাই অপূরণ রাখিনি, যখন যেটা চেয়েছে, সেটাই দিয়েছি”। সন্তান সবসময়ই পিতামাতার অত্যন্ত প্রিয়। সন্তানের সুখে পিতামাতাই সবচেয়ে বেশী খুশী হন এবং দুঃখে কষ্ট পান। কিন্তু পরিস্থিতি, দুঃখ-কষ্ট এগুলো সন্তানকে অনুধাবন করতে না দিলে, সেই সন্তানের মধ্যে পাওয়া না পাওয়ার, চাওয়া না চাওয়ার যে আনন্দ, বেদনা সেই অনুভূতিগুলো তার মাঝে প্রস্ফুটিত হবে না। স্বাভাবিকভাবে সে স্বার্থপর হয়েই বেড়ে উঠবে। অন্যের ইচ্ছা,অনিচ্ছার কোন তোয়াক্কাই করবেনা।
যাদের আমরা পথের মানুষ, পথের শিশু, অবহেলার ছলে টোকাই বলে ডাকি, ওদের কোথাও আশ্রয় নেই। আশ্রয়হীন বলেই পথই ওদের ঘর, পথেই ওদের বাস। ওরাও আমাদের মতো রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, রোদ, বৃষ্টি, শীতে ওদের যে কষ্ট হয় এই অনুভূতিটি, এই বোধশক্তিটি যদি আমাদের মধ্যে থাকে তবেই কোন মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবো, নয়তো না।
সেদিন আমার এক বন্ধু দুঃখের সাথে বলছিল, “এখন আত্মীয়স্বজন কারোর বাসায়ই যেতে ইচ্ছে করে না। ছোটবড় সবাই এতো ব্যাস্ত থাকে! কেউ ইন্টারনেটে, মোবাইলে, কেউ বা টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখায় মগ্ন। কথা বলার সময় নেই কারোরই। সত্যিই তাই। বরং অনেকে বিরক্তবোধও করে। সবাই ব্যাক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে, একা নিজের মতো থাকতেই বেশী পছন্দ করে। এতে একের প্রতি অন্যের দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সম্পর্কের ফাটল ধরছে। আত্মীয়স্বজন এমনকি পরিবারের সদস্যদের মাঝে একে অন্যের প্রতি, সন্তান ও পিতামাতার মাঝেও আন্তরিকতা ও ভালবাসার লোপ পাচ্ছে। যার কারনেই আমরা আজ লোমহর্ষক, নির্মম ঘটনাগুলো দেখতে পাই। সন্তান পিতামাতাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করছে, কাউকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, জবাই করে হত্যা করা, কুকুর বিড়ালের মতো বস্তায় ভরে রাস্তায় ফেলে দেয়া। আবার পিতামাতাও সন্তানকে গলা টিপে, বিষ খাইয়ে হত্যা করছে এমনকি পিতা কন্যাকে, পুত্র মাতাকে ধর্ষনের মতো নিন্দনীয় ও ঘৃণিত ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে। নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পেরে মানুষ মানুষকে ছুরিকাঘাতে নয়তো কুপিয়ে হত্যা করছে আর সবাই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, কারন সাহায্য করার বোধটি তাদের বিবেকে কড়া নাড়েনি।
দিনের পর দিন মানুষের মনুষ্যত্ব একটু একটু করে হরণ হচ্ছে। বিবেকের এই বোধশক্তির অভাবেই এমন নিঃসংশয় ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটেই চলেছে। অনেককে দেখি গরীব লোক কিংবা বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাদের সাথে খুব রূঢ় আচরণ করে, গায়ে হাত পর্যন্ত উঠিয়ে থাকে। এটা আমার কাছে খুবই অন্যায় একটি কাজ বলে মনে হয়। কোন গরীব বৃদ্ধ লোক বা বৃদ্ধা বুয়াকে দেখলেও কেন জানি ওরা আমার বাবা মায়ের আসনে বসে যায়, মনে হয় হতেও তো পারতো ওরা আমার বাবা কিংবা মা। তাদের সাথে তখন এই জঘন্য আচরণগুলো কি করতে পারতাম? শুধু গরীব বলেই কি এই দুর্ব্যবহার ওদের জন্য প্রাপ্য?
পথের মাঝে ইট, পাথর বা একটি কলার খোসাও কেউ যদি সরিয়ে দেয়, কারোর দুর্ঘটনা হতে পারে ভেবে, এই ছোট ছোট মন মানসিকতাও অবশ্যই মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ বা কল্যানকর অনুভূতিরই বর্হিপ্রকাশ। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বানালেই সন্তান মানুষ হয়না, মানুষের মতো মানুষ বানাতে হলে নৈতিক চরিত্রটিই প্রথমে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে আর এটার জন্য আলাদা করে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়না। নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। একটি পরিবারের পরিবেশ যেমন, শিশুটি সেই মন মানসিকতা নিয়েই বেড়ে উঠবে। তাই শিশুকাল থেকেই সন্তানদের মানুষের সাথে মেলামেশা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা, নিজেকে ভালবাসা, পরিবারের প্রতি ভালবাসা ও প্রত্যেকের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা, সবার সুখে-দুখে সামিল হয়ে যে যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, পাপ-পূণ্য, বিচারে ধর্মীয় এই শিক্ষাগুলো যদি তাদের মধ্যে তৈরি করে দেওয়া যায়, তবে অবশ্যই দায়িত্ববোধ ও ভালবাসার অন্তরে বিবেকের বোধশক্তিটি জাগ্রত হবেই। আর সবাই সত্যিকারের ভাল মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য এগিয়ে যাবেই।
পরবর্তী খবর হাসি খুশি মন, সুস্হ জীবন- পুনম মায়মুনী