অকালপ্রয়াত তারেক মাসুদ ও তাঁর চিরঞ্জীবী স্বপ্ন
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ১৩ই আগস্ট ২০১৭, রবিবার
| দুপুর ০২:০১
দেশ
ই-বার্তা।। চোখ যেমন মনের কথা বলে, ঠিক তেমনি রূপালী পর্দা বলে সমাজের কথা। আমাদের আশে পাশে যা ঘটে, তার পূর্ণ প্রতিফলন আমরা সিনেমায় দেখতে পাই। সিনেমা যেন সমাজের আয়না। যদিও সফলভাবে খুব কম পরিচালকই পেরেছেন এই বাস্ত চিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে। তারপরেও বাংলাদেশে খুব সচেতনভাবে আমাদের চারপাশের অবস্থাকে যারা রূপালি পর্দায় তুলে ধরতে পেরেছেন, তারেক মাসুদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
নিজের আশে-পাশে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনা সাজিয়ে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন আজীবন মনে রাখার মতো কিছু সিনেমা। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সিনেমা ফেরী করে বেড়াতেন মানুষটি। আর বয়ে বেড়াতেন তাঁর সিনেমার ঝুড়ি, যা আমাদের চারপাশের টুকরো ঘটনা দিয়ে ভরা। চোখে ছিল স্বপ্ন, এদেশের সিনেমা জগৎ কে বদলে দেয়া। মৃতপ্রায় রূপালি পর্দাকে দেশের অস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক পড়াকালীন সময়েই মূলত তারেক মাসুদ চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনিই এ দেশের পরিচালকদের মধ্যে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করেন। ফরিদপুর জেলায় জন্ম নেয়া তারেক মাসুদকে ছোটোবেলায় ইসলামি শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। নিজের মাদ্রাসা জীবনের ছায়া অবলম্বনে ২০০২ সালে তিনি নির্মান করেন তাঁর অন্যতম সেরা সিনেমা ‘মাটির ময়না’। ষাটের দশকের বাংলাদেশ, মানুষের জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের প্রভাবের সংমিশ্রণে তৈরী হয়েছে সিনেমাটি। এতে ফুটে উঠেছে ঘুণে ধরা সমাজের নারী-পুরুষ ভেদাভেদ, কাঠমোল্লাদের অন্ধ বিশ্বাস আর লোক দেখানো আচারের বিভিন্ন দিক। ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি
জিতে নেয় ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস প্রাইজ। এছাড়াও অস্কারে সেরা বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে প্রথম বাংলাদেশী সিনেমা হিসেবে মাটির ময়না মনোনয়ন পায়।
তারেক মাসুদের জীবনসঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন একজন মার্কিন নাগরিক। ক্যাথরিন এবং তারেক মিলে ঢাকায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন যার নাম অডিওভিশন। ক্যাথরিন ছিলেন একই সাথে তারেকের প্রিয়তমা স্ত্রী ও সহযোদ্ধা। তাঁদের একমাত্র সন্তান বিংহাম পুত্রা নিষাদ মাসুদ। জীবন যাপনে অতি সাধারণ তারেক মাসুদের কথায়, চিন্তায়, আচরণে একটা সহজ নিঃসংকোচ আবহ পাওয়া যেত।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জ থেকে ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশন ঠিক করে ঢাকা ফিরছিলেন তারেক মাসুদ। সাথে ছিলেন সাংবাদিক মিশুক মুনীর এবং ক্যাথরিন। রাস্তায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। রক্ষা পেয়ে যান ক্যাথরিন। তারেকের মৃত্যুর পর ক্যাথরিনের উদ্যোগে এবং শুভাকাঙ্খীদের সাহায্যে গড়ে উঠেছে ‘তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। তারেক মাসুদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলোকে সম্পূর্ণ করাই এই ট্রাস্টের উদ্দেশ্য। জীবন থেমে গিয়ে থামাতে পারেনি তারেক মাসুদের স্বপ্নগুলোকে। কারণ সহযোদ্ধা তো এখনো বেঁচে আছেন।
তারেক মাসুদের দর্শক ছিল গ্রামের অশিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত মানুষ। এমনকি বিদেশেও তিনি তাঁর যাদুর ছোঁয়া পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর সহজ-সাবলীল চিত্রায়ন ও সংলাপ বুঝতে পারবে না এমন মানুষ একটাও নেই। সিনেমাকে শিল্পে পরিণত করার উদ্যোগী এই মানুষটিকে দেশের বড় প্রয়োজন ছিলো। তাঁর অভাব হয়তো কোনোদিন পূরণ হবেনা। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া স্বপ্ন ও স্বপ্ন জাগানো কিছু কাজ নিশ্চয়ই হারিয়ে যাবেনা কোনোদিন।
আগের খবর আসুন ১ টাকা দিয়ে গর্ব করি