নাটক ও বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস
ই-বার্তা
প্রকাশিত: ১৬ই অক্টোবর ২০১৭, সোমবার
| সন্ধ্যা ০৬:১৩
দেশ
ই-বার্তা।। নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। নাটক,নাট্য,নট,নটী- এই শব্দগুলোর মূল শব্দ হল নট্। নট্ মানে হচ্ছে নড়াচড়া করা,অঙ্গচালনা করা। নাটকের ইংরেজী প্রতিশব্দ হলো Drama। Drama শব্দটি এসেছে গ্রিক Dracin শব্দ থেকে। যার অর্থ হলো to do বা কোন কিছু করা। নাটকের মধ্যেও আমরা মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নড়াচড়া,কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের বিশেষ কোন দিক বা ঘটনার উপস্থাপন দেখতে পাই।
সাহিত্যের প্রাচীন রুপটিকে কাব্য বলা হতো। কাব্য ছিল দুই প্রকার -শ্রব্য কাব্য ও দৃশ্য কাব্য। দৃশ্য কাব্যই মুলত বর্তমান সময়ের নাটক বা অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা। সংস্কৃতে নাটককে বলা হয়েছে দৃশ্যকাব্য। নাটককে শুধু দেখার বিষয় বললে পুরোটা বলা হয় না, এতে শোনারও বিষয় থাকে। নাটক মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে দেখা এবং সংলাপ শোনার মাধ্যমে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়। এটি একটি মিশ্র শিল্পমাধ্যম। সংস্কৃতিতে একে বলা হয়েছে কাব্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- কাব্যেষু নাটকং রম্যম্।
সাহিত্যের অন্যান্য শাখা মূলত পাঠের জন্য হলেও নাটকপ্রধানত অভিনয়ের জন্য। তাই এর বিশেষ কিছু গঠনবৈশিষ্ট্য রয়েছে। ক্ষেএবিশেষে পার্থক্য থাকলেও নাটকে সাধারণত চারটি উপাদান থাকে। সেগুলো হলো-কাহিনী,চরিত্র,সংলাপ,পরিবেশ।
প্রতিটি নাটকে এক বা একাধিক চরিত্র থাকে। নাটকের কাহিনী বা ঘটনা মূলত নাটকের এই পাত্রপাত্রী বা চরিত্রকে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। চরিত্রগুলোর পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভেতর দিয়নাটকের কাহিনী প্রকাশিত হয়। চরিত্রগুলো মুখর হয় সংলাপের ভেতর দিয়ে। বলা যায়,সংলাপ নাটকের প্রাণ। সংলাপের কাহিনী ও চরিত্রগুলোকে ব্যক্ত করে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। সংলাপের মাধ্যমেই তৈরি হয় নাট্যপরিস্থিতি।
কোন পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে এ ঘটনাটি ঘটছে বা কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে চরিত্র এ আচরণ করছে বা সংলাপ বলছে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয়। মঞ্চনাটকে মঞ্চসজ্জ,আলোকসম্পাত,শব্দযোজনা ইত্যাদির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে এ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এ কাজটি মূলত করেন নাট্য নির্দেশক। নাট্যকার তাঁর নাটকেই এর নির্দেশনা রাখেন। তবে উত্তম নাটকের বৈশিষ্ট্য হলো সংলাপের বা অভিনয়ের ভেতর দিয়েই নাটকের পরিবেশ সৃষ্টি করা।
একটি নাটক শুরু হওয়ার পর তার কাহিনীর বিকাশ ঘটবে, বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কাহিনীটি চূড়ান্ত দ্বন্দ্বমুহূর্ত সৃষ্টি হবে। তারপর কোন সত্য বা তথ্য প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যমে নাটকটির চূড়ান্ত দ্বন্দ্বপরিণতির দিকে যাবে এবং সবশেষে একটি পরিসমাপ্তি ঘটবে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে নাটক অভিনীত হওয়ার উল্লেখ রয়েছে।সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায়ও দেখা গেছে, চর্যাপদ নৃত্য ও অভিনয়সহ বৌদ্ধ মন্দিরে পরিবেশিত হতো। এ থেকে বলা যায় যে বাংলা নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের।
আমাদের যাত্রাপালার ঐতিহ্যও বেশ পুরনো। তবে নাটক অর্থে আমরা আধুনিক যে মঞ্চ নাটকের সাথে পরিচিত তা বাংলা অঞ্চলে এসেছে ইউরোপ থেকে। অবশ্য কলকাতার প্রথম মঞ্চনাটকের যিনি আয়োজন করেন তিনি ছিলেন একজন বাশিয়ান নাগরিক তার নাম হেরাসিম স্পেপানভিচ্ লেবেদেফ। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি ইংরেজি নাটক “দ্য ডিজগাইজ” বাংলায় রুপান্তর করে “কাল্পনিক সংবদল” নামে মঞ্চায়িত করেন। নাটকটি তাকে অনুবাদে সাহায্য করেন গোলকনাথ দাস।
প্রথম বাংলা আধুনিক নাটক রচনার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের(১৮২৪-১৮৭৩)। তিনি পাশ্চাত্য নাট্যরীতি অনুসরণ করে ১৮৫৯ সালে “শমিষ্ঠা” নাটক রচনা করেন। মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার। এ সময়ের অন্যান্য নাট্যকারের নাটক ও প্রহসনের মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের (১৮৬১-১৯৪১)এর “সিরাজউদ্দৌলা” (১৯০৬), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) “সাজাহান” (১৯০৯), ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের (১৮৬৪-১৯২৭) “প্রতাপদিত্য” (১৯০৩) ইত্যাদি। বাংলা নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার লিখিত বিখ্যাত নাটকসমূহের মধ্যে রয়েছে “ডাকঘর” (১৯১২), “রক্তকবরী” (১৯১৬), “চিত্রাঙ্গদা” (১৯৩৬), “চিরকুমার সভা” (১৯২৬), “বাল্মীকি প্রতিভা” (১৮৮১) প্রভৃতি।
ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গে ঢাকাকেন্দ্রিক নাট্যচর্চা গড়ে ওঠে। পূর্ববঙ্গের নাট্যচর্চার স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের সমাজবাস্তবতা-সমাজচিত্র চিত্রিত হতে থাকে, বিশেষত বাঙালি মুসলমান সমাজের চিত্র। এ ধারার নাট্যকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - নুরুল মোমেন(১৯০৬-১৯৮৯) ও আসকার ইবনেশাইখ।নুরুল মোমেন রচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে – “নয়া খান্দান”, “নেমেসিস”, “এমন যদি হতো”, “রুপান্তর” প্রভৃতি।
আসকার ইবনে শাইখের নাটকের মধ্যে রয়েছে – “তিতুমীর”, “অগ্নিগিরি”, “রক্তপদ্ম”, “বিদ্রোহী পদ্মা”, “এপার ওপার” প্রভৃতি। বাংলাদেশের আধুনিক ধারার নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) ও সৈয়দ ওয়ালীউলাহ (১৯২২-১৯৭১) অগ্রনী নাট্যকার।
এ ছাড়াও বাংলাদেশের আরও অনন্য নাট্যকার ও তাদের নাটকের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল, আব্দুল্লাহ আল মামুন (১৯৪৩-২০০৮) রচিত “সুবচন নির্বাসনে”, “এখন দুঃসময়”, “চারদিকে যুদ্ধ”, “সেনাপতি”, “অরক্ষিত মতিঝিল”। সেলিম আল দীন (১৯৪৮-২০০৮) রচিত “জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন”, “সর্প বিষয়ক গল্প”, “কিত্তনখোলা”, “প্রাচ্য”, “নিমজ্জন”। সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) রচিত “নূরুলদীনের সারা জীবন”, “পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়”, “গণনায়ক”। মামুনুর রশীদ (১৯৪৮) রচিত “ওরা কদম আলি”, “ওরা আছে বলেই”, “ইবলিশ”, “এখানে নোঙর” ইত্যাদি।
আগের খবর অসুস্থতা দূর করবে মিউজিক থেরাপি
পরবর্তী খবর শ্রদ্ধা প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি